মাতৃহীনা বলিয়া বোধ হইত, সেই পৃথিবীকে আনতনয়না চিরজাগ্রত জননীর কোলে দেখিতে পাইলেন। পৃথিবীর দুঃখশোকদারিদ্র্য বিবাদবিদ্বেষ দেখিলেও তাঁহার মনে আর নৈরাশ্য জন্মিত না। একটিমাত্র মঙ্গলের চিহ্ন দেখিলেই তাঁহার আশা সহস্র অমঙ্গল ভেদ করিয়া স্বর্গাভিমুখে প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিত। আমাদের সকলের জীবনেই কি কোনো-না-কোনোদিন এমন এক অভূতপূর্ব নূতন প্রেম ও নূতন স্বাধীনতার প্রভাত উদিত হয় নাই, যেদিন সহসা এই হাস্যক্রন্দনময় জগৎকে এক সুকোমল নবকুমারের মতো এক অপূর্ব সৌন্দর্য প্রেম ও মঙ্গলের ক্রোড়ে বিকশিত দেখিয়াছি! যেদিন কেহ আমাদিগকে ক্ষুব্ধ করিতে পারে না, কেহ আমাদিগকে জগতের কোনো সুখ হইতে বঞ্চিত করিতে পারে না, কেহ আমাদিগকে কোনো প্রাচীরের মধ্যে রুদ্ধ করিয়া রাখিতে পারে না! যেদিন এক অপূর্ব বাঁশি বাজিয়া উঠে, এক অপূর্ব বসন্ত জাগিয়া উঠে, চরাচর চিরযৌবনের আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া যায়! যেদিন সমস্ত দুঃখ-দারিদ্র্য-বিপদকে কিছুই মনে হয় না! নূতন স্বাধীনতার আনন্দে প্রসারিতহৃদয় গোবিন্দমাণিক্যের জীবনে সেই দিন উপস্থিত হইয়াছে।
দক্ষিণ-চট্টগ্রামের রামু শহর এখনো দশ ক্রোশ দূরে। সন্ধ্যার কিঞ্চিৎ পূর্বে গোবিন্দমাণিক্য যখন আলম্খাল-নামক ক্ষুদ্র গ্রামে গিয়া পৌঁছিলেন, তখন গ্রামপ্রান্তবর্তী একটি কুটির হইতে ক্ষীণকণ্ঠ বালকের ক্রন্দনধ্বনি শুনিতে পাইলেন। গোবিন্দমাণিক্যের হৃদয় সহসা অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল। তিনি তৎক্ষণাৎ সেই কুটিরে গিয়া উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন, যুবক কুটিরস্বামী একটি শীর্ণ বালককে কোলে করিয়া লইয়া ঘরের মধ্যে পায়চারি করিতেছে। বালক থর্থর্ করিয়া কাঁপিতেছে এবং থাকিয়া থাকিয়া ক্ষীণ কণ্ঠে কাঁদিতেছে। কুটিরস্বামী তাঁহাকে বুকের মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া ঘুম পাড়াইবার চেষ্টা করিতেছে। সন্ন্যাসবেশী গোবিন্দমাণিক্যকে দেখিয়া সে শশব্যস্ত হইয়া পড়িল। কাতর