পাতা:রাজর্ষি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.djvu/৪৯

এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
৪৮
রাজর্ষি

 সকলে চুপ করিয়া রহিল। অবশেষে কথা উঠিতে লাগিল। অস্পষ্ট স্বরে কেহ কেহ বলিতে লাগিল, “রাজার নিষেধ, আমরা কী করিব!”

 জয়সিংহ প্রস্তরের পুত্তলিকার মতো স্থির হইয়া বসিয়াছিলেন। ‘মায়ের নিষেধ’ এই কথা তড়িদ্‌‍বেগে তাঁহার রসনাগ্রে উঠিয়াছিল— কিন্তু তিনি আপনাকে দমন করিলেন, একটি কথা কহিলেন না!

 রঘুপতি তীব্রস্বরে বলিয়া উঠিলেন, “রাজা কে! মায়ের সিংহাসন কি রাজার সিংহাসনের নীচে? তবে এই মাতৃহীন দেশে তোদের রাজাকে লইয়াই তোরা থাক্‌। দেখি তোদের কে রক্ষা করে!”

 জনতার মধ্যে গুন্‌ গুন্‌ শব্দ উঠিল। সকলেই সাবধানে কথা কহিতে লাগিল।

 রঘুপতি দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলেন, “রাজাকেই বড়ো করিয়া লইয়া তোদের মাকে তোরা রাজ্য হইতে অপমান করিয়া বিদায় করিলি! সুখে থাকিবি মনে করিস নে। আর তিন বৎসর পরে এতবড়ো রাজ্যে তোদের ভিটের চিহ্ন থাকিবে না—তোদের বংশে বাতি দিবার কেহ থাকিবে না।”

 জনতার মধ্যে সাগরের গুন্‌ গুন্‌ শব্দ ক্রমশঃ স্ফীত হইয়া উঠিতে লাগিল। জনতাও ক্রমে বাড়িতেছে। সেই দীর্ঘ লোকটি জোড়হাত করিয়া রঘুপতিকে কহিল, “সন্তান যদি অপরাধ ক’রে থাকে তবে মা তাকে শাস্তি দিন; কিন্তু মা সন্তানকে একেবারে পরিত্যাগ করে যাবে একি কখনো হয়! প্রভু, ব’লে দিন কী করলে মা ফিরে আসবেন।”

 রঘুপতি কহিলেন, “তোদের এই রাজা যখন এ রাজ্য হইতে বাহির হইয়া যাইবেন, মাও তখন এই রাজ্যে পুনর্বার পদার্পণ করিবেন।”

 এই কথা শুনিয়া জনতার গুন্ গুন্‌ শব্দ হঠাৎ থামিয়া গেল। হঠাৎ চতুর্দিক সুগভীর নিস্তব্ধ হইয়া গেল, অবেশেষে পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে চাহিতে লাগিল; কেহ সাহস করিয়া কথা কহিতে পারিল না।