সমস্ত দিন অবিশ্রাম চলিয়া রঘুপতি যখন বনের মধ্যে প্রবেশ করিলেন তখন রাত্রি হইয়াছে। অধিকাংশ সৈন্য নিস্তব্ধে ঘুমাইতেছে, অল্পমাত্র সৈন্য নীরবে পাহারা দিতেছে। মাঝে মাঝে এক-এক জায়গায় আগুন জ্বলিতেছে– অন্ধকার যেন বহু কষ্টে নিদ্রাক্রান্ত রাঙা চক্ষু মেলিয়াছে। রঘুপতি বনের মধ্যে পা দিয়াই কুড়ি হাজার সৈনিকের নিশ্বাস-প্রশ্বাস যেন শুনিতে পাইলেন। বনের সহস্র গাছ শাখা বিস্তার করিয়া পাহারা দিতেছে। কালপেচক তাহার সদ্যোজাত শাবকের উপর যেমন পক্ষ প্রসারিত করিয়া বসিয়া থাকে, তেমনি অরণ্যের বাহিরকার বিরাট রাত্রি অরণ্যের ভিতরকার গাঢ়তর রাত্রির উপর চাপিয়া ডানা ঝাঁপিয়া নীরবে বসিয়া আছে– অরণ্যের ভিতরে এক রাত্রি মুখ গুঁজিয়া ঘুমাইয়া আছে, অরণ্যের বাহিরে এক রাত্রি মাথা তুলিয়া জাগিয়া আছে। রঘুপতি সে রাত্রে বনপ্রান্তে শুইয়া রহিলেন।
সকালে গোটা দুই-চার খোঁচা খাইয়া ধড়্ফড়্ করিয়া জাগিয়া উঠিলেন। দেখিলেন জন-কত পাগড়ি-বাঁধা দাড়ি-পরিপূর্ণ তুরানি সৈন্য বিদেশী ভাষায় তাঁহাকে কী বলিতেছে; শুনিয়া তিনি নিশ্চয় অনুমান করিয়া লইলেন, গালি। তিনিও বঙ্গভাষায় তাহাদের শ্যালক-সম্বন্ধ প্রচার করিয়া দিলেন। তাহারা তাঁহাকে টানাটানি করিতে লাগিল। রঘুপতি বলিলেন, “ঠাট্টা পেয়েছিস?” কিন্তু তাহাদের আচরণে ঠাট্টার লক্ষণ কিছুমাত্র প্রকাশ পাইল না। বনের মধ্য দিয়া তাহারা তাঁহাকে অকাতরে টানিয়া লইয়া যাইতে লাগিল।
তিনি সবিশেষ অসন্তোষ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “টানাটানি কর কেন? আমি আপনিই যাচ্ছি। এত পথ আমি এলুম কী করতে?”
সৈন্যেরা হাসিতে লাগিল ও তাঁহার বাংলা কথা নকল করিতে লাগিল। ক্রমে ক্রমে তাঁহার চতুর্দিকে বিস্তর সৈন্য জড়ো হইল, তাঁহাকে লইয়া ভারী গোল পড়িয়া গেল। উৎপীড়নেরও সীমা রহিল না।