११ झछनैौ বিশ্বাস ছিল যে, অল্প দিনের জঙ্ক যাইতেছি। বিবাহের কথা নিবৃত্তি পাইলেই আবার আসিব । - আমি চাপার গৃহে—আমার শ্বশুরবাড়ী ?—উপস্থিত হইলে চাপা আমায় সপ্তই লোক সঙ্গে দিয়া বিদায় করিল। পাছে তাহার স্বামী জানিতে পারে, এই ভয়ে বড় তাড়াতাড়ি করিল—যে লোক সঙ্গে দিল, তাহার সঙ্গে যাওয়ার পক্ষে আমার বিশেষ আপত্তি—কিন্তু চাপা এমনই তাড়াতাড়ি করিল যে, আমার আপত্তি ভাসিয়া গেল। মনে কর, কাহাকে আমার সঙ্গে দিল ? হীরালালকে । হীরালালের মন্দ চরিত্রের কথা তখন আমি কিছুই জানিতাম না । সেজন্য আপত্তি করি নাই। সে যুবা পুরুষ—আমি যুবতী—তাহার সঙ্গে কি প্রকারে এক যাইব ? এই আপত্তি। কিন্তু তখন আমার কথা কে শুনে ? আমি অন্ধ, পথ অপরিচিত, রাত্রে আসিয়াছি—সুতরাং পথে যে সকল শব্দঘটিত চিহ্ন চিনিয়া রাখিয়া আসিয়া থাকি, সে সকল কিছু শুনিতে পাই নাই—অতএব বিনা সহায়ে বাড়ী ফিরিয়া যাইতে পারিলাম না—বাড়ী ফিরিয়া গেলেও সেই পাপ বিবাহ । অগত্য হীরালালের সঙ্গে যাইতে হইল। তখন মনে হইল—আর কেহ অন্ধের সহায় থাক না থাক—মাথার উপর দেবতা আছেন ; তাহার কখনও লবঙ্গলতার হ্যায় পীড়িতকে পীড়ন করিবেন না ; তাহাদের দয়া আছে, শক্তি আছে, অবশ্ব দয়া করিয়া আমাকে রক্ষা করিবেন—নহিলে দয়া কার জন্য ? তখন জানিতাম না যে, ঐশিক নিয়ম বিচিত্র—মন্বয়ের বুদ্ধির অতীত—আমরা যাহাকে দয়া বলি, ঈশ্বরের অনন্ত জ্ঞানের কাছে তাহা দয়া নহে—আমরা যাহাকে পীড়ন বলি–ঈশ্বরের অনন্ত জ্ঞানের কাছে তাহ পীড়ন নহে। তখন জানিতাম না যে, এই সংসারের অনন্ত চক্র দয়াদাক্ষিণ্যশূন্ত, সে চক্র নিয়মিত পথে অনতিক্ষুণ্ণ রেখায় অহরহ চলিতেছে, তাহার দারুণ বেগের পথে যে পড়িবে—অন্ধ হউক, খঞ্জ হউক, আৰ্ত্ত হউক, সেই পিষিয়া মরিবে । আমি অন্ধ নিঃসহায় বলিয়া, অনস্ত সংসারচক্র পথ ছাড়িয়া চলিবে কেন ? হীরালালের সঙ্গে প্রশস্ত রাজপথে বাহির হইলাম—তাহার পদশব্দ অনুসরণ করিয়া চলিলাম—কোথাকার ঘড়িতে একটা বাজিল। পথে কেহ নাই—কোথাও শব্দ নাই—ছুই একখানা গাড়ির শব্দ–তুই একজন সুরাপহৃতবুদ্ধি কামিনীর অসম্বন্ধ গীতিশব্দ । আমি হীরালালকে সহসা জিজ্ঞাসা করিলাম,—“হীরালাল বাবু, আপনার গায়ে জোর কেমন " | হীরালাল একটু বিস্মিত হইল—বলিল, “কেন ?” আমি বলিলাম, “জিজ্ঞাসা করি ?”
পাতা:রাধারাণী-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৬২
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।