২৬ রজনী তরঙ্গ উঠে, তাহ বুঝিতে পারে? মুখ হািখ ! ই মুখও আছে। যখন চৈত্র মাসে, , ফুলের বোঝার সঙ্গে সঙ্গে মৌমাছি ছুটিয়া আমাদের গৃহমধ্যে প্রবেশ করিত, তখন সে শব্দের সঙ্গে আমার কত সুখ উছলিত, কে বুঝিত ? যখন গীতিব্যবসায়িনীর অট্টালিকা হইতে বাছনিৰুণ, সান্ধ্য সমীরণে কৰ্ণে আসিত, তখন আমার মুখ কে বুঝিয়াছে ? যখন বামাচরণের আধ আধ কথা ফুটিয়াছিল—জল বলিতে “ত” বলিত, কাপড় বলিতে “খাৰ” বলিত, রজনী বলিতে “জুপ্রি” বলিত, তখন আমার মনে কত মুখ উছলিত, তাহা কে বুৰিয়াছিল । আমার দুঃখই বা কে বুঝিবে ? অন্ধের রূপোন্মাদ কে বুঝিবে ? না দেখায় যে ছঃখ, তাহ কে বুঝিবে ? বুঝিলেও বুঝিতে পারে, কিন্তু দুঃখ যে কখন প্রকাশ করিতে পারিলাম না, এ ছুঃখ কে বুঝিবে ? পৃথিবীতে যে দুঃখের ভাবা নাই, এ দুঃখ কে বুঝিবে ? ছোট মুখে বড় কথা তোমরা ভালবাস না, ছোট ভাষায় বড় দুঃখ কি প্রকাশ করা যায় ? এমনই দুঃখ যে, আমার যে কি দুঃখ, তাহাতে হৃদয় ধ্বংস হইলেও, সকলটা আপনি মনে ভাবিয়া আনিতে পারি না । মনুষ্যভাষাতে তেমন কথা নাই—মমুষ্যের তেমন চিন্তাশক্তি নাই। দুঃখ ভোগ করি—কিন্তু হুঃখটা বুৰিয়া উঠিতে পারি না। আমার কি দুঃখ ? কি তাহা জানি না, কিন্তু হৃদয় ফাটিয়া যাইতেছে । সৰ্ব্বদা দেখিতে পাইবে যে, তোমার দেহ শীর্ণ হইতেছে, বল অপহৃত হইতেছে, কিন্তু তোমার শারীরিক রোগ কি, তাহ জানিতে পারিতেছ না। তেমনি অনেক সময়ে দেখিবে যে, দুঃখে তোমার বক্ষ বিদীর্ণ হইতেছে, প্রাণ বাহির করিয়া দিয়া, শূন্তমার্গে পাঠাইতে ইচ্ছা করিতেছে—কিন্তু কি দুঃখ, তাহ আপনি বুঝিতে পারিতেছ না। আপনি বুঝিতে পারিতেছ না—পরে বুঝিবে কি ? ইহা কি সামান্ত দুঃখ ? সাধ করিয়া বলি, জীবন অসার । ষে জীবন এমন দুঃখময়, তাহার রক্ষার জন্য এত ভয় পাইতেছিলাম কেন ? আমি কেন ইহা ত্যাগ করি না ? এই ত কলনাদিনী গঙ্গার তরঙ্গমধ্যে দাড়াইয়া আছি—আর দুই পা অগ্রসর হইলেই মরিতে পারি। না মরি কেন ? এ জীবন রাখিয়া কি হইবে ? মরিব । আমি কেন জন্মিলাম ? কেন অন্ধ হইলাম ? জন্মিলাম ত শচীশ্রের যোগ্য হইয়া জন্মিলাম না কেন ? শচীন্দ্রের যোগ্য ন হইলাম, তবে শচীন্দ্রকে ভালবাসিলাম কেন ? ভালবাসিলাম, তবে তাহার কাছে রহিতে পারিলাম না কেন ? কিসের জন্ত শচীন্দ্রকে ভাবিয়া, গৃহত্যাগ করিতে হইল ? নিঃসহায় অন্ধ, গঙ্গার চরে মরিতে আসিলাম কেন ?
পাতা:রাধারাণী-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৬৬
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।