তৃতীয় পরিচ্ছেদ শেষে রাজচন্দ্র দাসের কাছে শুনিতে পাইলাম যে, রজনীকে পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু রাজচন্দ্র দাস এ বিষয়ে আমাদিগের সঙ্গে বড় চমৎকার ব্যবহার করিতে লাগিল। রজনীকে কোথায় পাওয়া গেল, কি প্রকারে পাওয়া গেল, তাহা কিছুই বলিল না। আমরা অনেক জিজ্ঞাসা করিলাম, কিছুতেই কোন কথা বাহির করিতে পারিলাম না। সে কেনই বা গৃহত্যাগ করিয়া গিয়াছিল, তাহাও জিজ্ঞাসাবাদ করিলাম, তাহাও বলিল না। তাহার স্ত্রীও ঐরূপ—ছোট মা, সূচীর হ্যায় লোকের মনের ভিতর প্রবেশ করেন, কিন্তু তাহার কাছে হইতে কোন কথাই বাহির করিতে পারিলেন না। রজনী স্বয়ং আর আমাদের বাড়ীতে আসিত না । কেন আসিত না, তাহাও কিছু জানিতে পরিলাম না । শেষে রাজচন্দ্র ও তাহার স্ত্রীও আমাদিগের বাড়ী আসা পরিত্যাগ করিল। ছোট মা কিছু দুঃখিত হইয়া তাহাদিগের অনুসন্ধানে লোক পাঠাইলেন। লোক ফিরিয়া আসিয়া বলিল যে, উহার সপরিবারে অক্ষত্র উঠিয়া গিয়াছে, সাবেক বাড়ীতে আর নাই। কোথায় গিয়াছে, তাহার কোন ঠিকানা করিতে পারিলাম না। ইহার এক মাস পরে, একজন ভদ্রলোক আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে অসিলেন। তিনি আসিয়াই, আপনি আত্মপরিচয় দিলেন। “আমার নিবাস কলিকাতায় নহে। আমার নাম অমরনাথ ঘোষ, আমার নিবাস শান্তিপুর।” তখন আমি তাহার সঙ্গে কথোপকথনে নিযুক্ত হইলাম। কি জন্য তিনি আসিয়াছিলেন, আমি তাহাকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না । তিনিও প্রথমে কিছু বলিলেন না । সুতরাং সামাজিক ও রাজকীয় বিষয়ঘটিত নানা কথাবাৰ্ত্ত হইতে লাগিল। দেখিলাম, তিনি কথাবার্তায় অত্যন্ত বিচক্ষণ। র্তাহার বুদ্ধি মার্জিত, শিক্ষা সম্পূর্ণ, এবং চিন্তু বহুদূরগামিনী। কথাবাৰ্ত্তায় একটু অবসর পাইয়া, তিনি আমার টেবিলের উপরে স্থিত “সেক্ষপিয়র গেলেরির” পাতা উল্টাইতে লাগিলেন। ততক্ষণ আমি অমরনাথকে দেখিয়া লইতে লাগিলাম। অমরনাথ দেখিতে স্বপুরুষ ; গৌরবর্ণ, কিঞ্চিৎ খৰ্ব্ব, স্কুলও নহে, শীর্ণও নহে ; বড় বড় চক্ষু, কেশগুলি সূক্ষ্ম, কুঞ্চিত, যক্ষ্ণরঞ্জিত। বেশভূষার পারিপাট্যের । বাড়াবাড়ি নাই, কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বটে। তাহার কথা কহিবার ভঙ্গ অতি মনোহর; কণ্ঠ অতি সুমধুর। দেখিয়া বুৰিলাম, লোক অতি সুচতুর।
পাতা:রাধারাণী-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৮৬
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।