পাতা:রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ.djvu/২৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নবম পরিচ্ছেদ।
২৩১

হইয়া উঠিতে লাগিল। প্রভাকরের কবিতা পড়িবার জন্য বাঙ্গাল দেশের লোক পাগল হইয়া উঠিল। প্রভাকর বাহির হইলে বিক্রেতৃগণ রাস্তার মোড়ে দাঁড়াইয়া ঐ সকল কবিতা পাঠ করিত এবং দেখিতে দেখিতে কত কাগজ বিক্রয় হইয়া যাইত! ক্রমে দেশে ঈশ্বরচন্দ্রী কবিদল দেখা দিল; এবং বঙ্গসাহিত্যে এক নবযুগের সূত্রপাত হইল। এখন যেমন ছোট বড়, পুরুষ স্ত্রীলোক যিনি কবিতা রচনা করেন তিনিই রবীন্দ্রনাথের ছাঁচে চালিয়া থাকেন, তখন কবিতা রচনার জন্য যে কেহ লেখনী ধারণ করিতেন তিনি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে ঈশ্বরচন্দ্রের ছাঁচে ঢালিতেন। দেখিতে দেখিতে ঈশ্বরচন্দ্রের অনুকরণে শিষ্য-প্রশিষ্য-শাখা-প্রশাখা-সমন্বিত এক কবি-সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হইল। এই শিষ্যদলের মধ্যে সুধীরঞ্জন প্রণেতা দ্বারকানাথ অধিকারী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, হরিমোহন সেন, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও মনোমোহন বসু পরবর্তী সময়ে খ্যাতি প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছেন। ইহাদের মধ্যে পদ্মিনীর উপাখ্যান প্রণেতা রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় কিয়ৎপরিমাণে গুরুর পদবী অতিক্রম করিয়া কিছু মৌলিকত্ব প্রদর্শন করিয়াছেন। তাঁহার রচিত কবিতা এক সময় বঙ্গদেশের পাঠকবৃন্দকে বিশেষ আনন্দ প্রদান করিয়াছিল। আমাদের যৌবনকালে যে সকল ব্যক্তির প্রতিভা আমাদিগকে কাব্যজগতে প্রবেশ করিবার জন্য উন্মুখ করছিল, তন্মধ্যে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এক জন ছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই।

 যাহা হউক ১৮৫৩ সালে ঈশ্বরচন্দ্র “পাষণ্ড-পীড়ন” নামক এক পত্র বাহির করেন। “ভাস্কর” পত্রের সম্পাদক গৌরীশঙ্কুর তর্কবাগীশ মহাশর কর্ত্তৃক প্রকাশিত “রসরাজ” পত্রের সহিত কবিতাযুদ্ধ ও গালাগালি করা ঐ “পাষণ্ড-পীড়নের” প্রধান কার্য্য হইয়া উঠে। তখন বঙ্গীয় আসরে প্রতিনিয়ত যে কবির লড়াই চলিত, সাহিত্যক্ষেত্রে সেই কবির লড়াইকে অবতীর্ণ করা উক্ত পত্রদ্বয়ের উদ্দেশ্য ছিল। সে অভদ্র, অশ্লীল, ব্রীড়াজনক উক্তি প্রত্যুক্তির বিষয় স্মরণ করিলে এখনও লজ্জা হয়। ইহাতে বঙ্গসাহিত্যজগতে এরূপ অশ্লীলতার স্রোত বহিয়াছিল, যাহার অনুরূপ নিকৃষ্ট রুচি আর কোনও দেশের ইতিবৃত্তে দেখা যায় না। প্রকাশ পত্রে যে সে সকল বিষয় কিরূপে প্রকাশিত হইত তাহা ভাবিলে আশ্চর্যান্বিত হইতে হয়।

 সুখের বিষয় যে বাঙ্গালা ১২৫৪ সালের মধ্যেই পাষণ্ড-পীড়ন উঠিয়া যায়।