পূজার কাষ্ঠাসনে বসাইয়া তাম্রকুণ্ডে তাঁহার পদদ্বয় স্থাপন-পূর্ব্বক পুষ্প চন্দনদ্বারা পূজা করিতেন। তাঁহার ধর্ম্মপরায়ণা মাতা নাকি দেবার্চ্চনার জন্য ব্যবহৃত তাম্রকুণ্ডে পা রাখিতে চাহিতেন না। পুৎত্র বলপূর্ব্বক পদদ্বয় তাহাতে সন্নিবেশিত করিলে, তিনি ভয়ে কাঁপিতেন, এবং বলিতেন—“কেশব! কেশব! কর কি, আমার যে গা কাঁপচে”। কেশব বলিতেন—“রাখ রাখ, তুমিই আমার আরাধ্য দেবতা”। এমন পিতার পুৎত্র ও এমন জ্যেষ্ঠের কনিষ্ঠ যিনি তাঁহাতে আমরা যে প্রকার সাধুভক্তি দেখিয়াছিলাম তাহা কিছুই বিচিত্র নহে।
রামতনু বাবু রামকৃষ্ণের পঞ্চম পুৎত্র ও সপ্তম সন্তান। তাঁহার অগ্রে কেশবচন্দ্র ভিন্ন আর তিন সহোদর ও দুই সহোদরা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহাদের সকলেই অল্প বয়সে গত হইয়া কেবল কেশবচন্দ্র ও ভবসুন্দরী থাকেন। রামতনু বাবুর পরে আর তিন সহোদর জন্মেন। তাঁহাদের নাম রাধাবিলাস, শ্রীপ্রসাদ ও কালীচরণ। রাধাবিলাস কলেজ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া যশোহরে স্বীয় জ্যেষ্ঠের সাহায্য করিতে যান। সেখানে ম্যালেরিয়া জ্বরে দুই ভ্রাতার মৃত্যু হয়। কালীচরণ বাবু কলিকাতা মেডিকেল কলেজে শিক্ষালাভ করিয়া চিকিৎসক হইয়া বাহির হন; এবং কয়েক বৎসর পূর্ব্ব পর্য্যন্ত কৃষ্ণনগরে ডাক্তারি করিতেন। তাঁহার বাল্যকালের বিষয়ে দেওয়ান কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায় স্বলিখিত আত্ম-জীবন-চরিতে এই প্রকার বর্ণন করিয়াছেন;—“কালীচরণও আমাকে যার পর নাই ভাল বাসিতেন। তিনি কলিকাতা হইতে আমার প্রয়োজনীয় পুস্তক সকল আনিয়া দিতেন; এবং বাটীতে অবস্থান কালে আমার পাঠের বিষয়ে বহু আনুকুল্য করিতেন। * * * * কালীচরণ বড় খোস-পোষাকী ছিলেন। তিনি মেডিকেল কালেজে যে ছাত্রবৃত্তি পাইতেন, তাহাতে উত্তম উত্তম ধুতি উড়ানী ও বিনামা ক্রয় করিতেন। যখন বাটী আসিতেন তখন ইহার কোন দ্রব্য আমাকে জেদ করিয়া দিতেন; আর কহিতেন “ছোড়্ দাদা, এসকল দ্রব্য তোমার অঙ্গে যেমন ভাল দেখায় তেমন আমার অঙ্গে দেখায় না।”
বাল্যে কালীচরণ বাবুর যে সহৃদয়তা দৃষ্ট হইয়াছিল, তাহা চিরজীবন তাঁহাকে পরিত্যাগ করে নাই। উত্তরকালে তিনি যখন কৃষ্ণনগরের সর্ব্বপ্রধান চিকিৎসকরূপে বিরাজ করিতেছিলেন, তখন তাঁহার মধুর ব্যবহার, সুমিষ্ট ভাষা, ও দীনে দয়া দেখিয়া সকলেরই চিত্ত বিশেষরূপে আকৃষ্ট হইয়াছিল। তাঁহার মুখ দেখিলেই রোগীর অর্দ্ধেক রোগ পলাইয়া যাইত। তিনি দীন দরিদ্রদিগকে বিনা ভিজিটে দেখিতেন; এবং অনেক সময়ে নিজ ঔষধালয়