পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যজ্ঞ-কথা : পুরুষ-যজ্ঞ তন্ত্রপন্থীও এই বাক্যকে ঘুরাইয়া বলিয়াছেন, “যৎ করোমি জগন্মাতস্তদেব তব পুজনম্।” মনে রাখিবেন, যজ্ঞ ও পুজা উভয়েরই তাৎপৰ্য্য সমান। যজ্ঞ নানাবিধ —“দ্রব্যযজ্ঞাস্তপোযজ্ঞ যোগযজ্ঞাস্তথাপরে, স্বাধ্যায়-জ্ঞানযজ্ঞাশ্চ”—কাহারও নিকট দ্রব্য ত্যাগই যজ্ঞ, কাহারও বা তপস্যা যজ্ঞ, কাহারও যোগ যজ্ঞ, বেদাধ্যয়ন ও জ্ঞানার্জনই কাহারও নিকট যজ্ঞ । কেহ বা যাবতীয় ইন্দ্রিয়কে সংযমাগ্নিতে আহুতি দেন, কেহ বা রূপ-রসাদি ভোগ্য দ্রব্যকে ইন্দ্রিয়াগ্নিতে আহুতি দেন। আবার কেহ বা সমস্ত ইন্দ্ৰিয়কৰ্ম্ম ও প্রাণকৰ্ম্মকে আত্মসংযম-যোগাগ্নিতে আহুতি দেন। ফলে কৰ্ম্ম মাত্রই যজ্ঞ—ত্যাগাত্মক কৰ্ম্ম মাত্ৰই যজ্ঞ ; যজ্ঞদেবতার উদ্দেশে সম্পাদিত যজ্ঞ । কে কাহার উদ্দেশে কোন দ্রব্য আহুতি দেয় ? ইহার উত্তরে আঙ্গিরসশিষ্য কৃষ্ণ গীতার মধ্যেই যজ্ঞতত্ত্বের চরম কথা বলিতেছেন,–“ব্ৰহ্মাপণং ব্রহ্মহবিঃ ব্রহ্মাগ্নে ব্রহ্মণা হুতম, ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকৰ্ম্মসমাধিনা” –এই জীবনযজ্ঞ ব্ৰহ্মকৰ্ম্ম ; ব্ৰহ্মই এখানে যজমান বা ঋত্বিকু সাজিয়া আহুতি দিতেছেন, ব্ৰহ্মই এখানে অগ্নি, ব্রহ্মই এখানে হোমত্রব্য, ব্ৰহ্মই এখানে দেবতা ; এই ব্ৰহ্মকৰ্ম্ম-সম্পাদনে ব্ৰহ্মলাভই ঘটে । জীবনের কৰ্ম্ম মাত্ৰই যজ্ঞ । যজ্ঞের মূল অর্থ ত্যাগ ; ত্যাগের পর যাহা অবশিষ্ট থাকিবে, তাহারই ভোগ কৰ্ত্তব্য—ইহাই হবিঃশেষ-ভোজন, অতএব অমৃতভোজন ; “ষজ্ঞশিষ্টামৃতভুজে যান্তি ব্ৰহ্ম সনাতনম্।” জীবনের প্রত্যেক কৰ্ম্মকে এই ষজ্ঞরূপে দেখিলে জীবনটাই উচু হইয় পড়ে—নীচের পরদ হইতে উঠিয়া অত্যন্ত উচু পরদায় উপনীত হয় ; জীবনের অর্থ পৰ্য্যস্ত বদলাইয়া যায়। অতি প্রাচীন কাল হইতেই বেদপন্থী সমাজে কৰ্ম্মকাণ্ড যখন অত্যন্ত জটিল ও যন্ত্রবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল, সেই সময় হইতেই এ কথার স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। এখনও যে আমরা জীবনযজ্ঞের সেই তত্ত্বটি ধরিয়া আছি, দুই একটা দৃষ্টান্ত দিলে বুঝিতে পারিবেন। আপনারা গৃহস্থের নিত্যকৰ্ত্তব্য পঞ্চ মহাযজ্ঞের কথা জানেন । মনুষ্য জন্ম মাত্রেই কয়েকট ঋণে বদ্ধ হইয়া জন্মে, ইহা মানব-জন্ম সম্বন্ধে অতি প্রাচীন থিয়োরি । “জায়মানো বৈ ব্রাহ্মণস্ত্রিভি; ঋনৈঃ ঋণবান জায়তে ” উত্তর কালে এই তিন ঋণ পাচ ঋণে দাড়াইয়াছে। দেবগণ মানুষের ভাগ্যবিধাতা ; পিতৃগণ র্তাহাকে মানবজন্ম দিয়াছেন ; ঋষিগণ যে বিদ্যা প্রচার করিয়া গিয়াছেন, সেই বিদ্যাই তাহাকে উৎকৃষ্ট দ্বিতীয় জন্মের অধিকারী করিয়াছে ; বন্ধু প্রতিবেশী হইতে সমাজের যাবতীয় ব্যক্তি র্তাহাকে রক্ষা করিতেছে ; পশু পক্ষী, কীট পতঙ্গ পর্ধ্যস্ত কোন-না-কোনরূপে তাহার জীবন রক্ষার সাহায্য করিতেছে। অতএব ইহাদের সকলের নিকটেই ঋণ আছে। এই পাচটি ঋণ লইয়াই মানুষকে জন্মিতে হয়। ঋণের বোঝা ফেলিয়া রাখিয়া জীবনযাত্রাট দুষ্কৰ্ম্ম । জীবন ব্যাপিয়া এই ঋণশোধের চেষ্টা করিতে হইবে। এক একটা ঋণশোধের চেষ্টার অভ্যাস এক একটা যজ্ঞ । প্রত্যেক যজ্ঞেই কিছু-না-কিছু ত্যাগ স্বীকার করিতে হয়। তৈত্তিরীয় আরণ্যক বলিতেছেন,—“যদগ্নৌ জুহোতি অপি সমিধং, তৎ দেবষজ্ঞঃ সস্তিষ্ঠতে”–দেবতার উদ্দেশে আগুনে অন্ততঃ একখানা সমিং ফেলিয়া দিলেও দেবযজ্ঞ সম্পন্ন হয় । “বং পিতৃভ্য: স্বধা করোতি অপি অপঃ, তৎ পিতৃষঙ্গ সস্তিষ্ঠতে”—পিতৃগণের উদেশে