রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র বা শিক্ষিত লোকে সেখানে কলেরা ব্যাসিলাসের ভয়ে পদার্পণে কুষ্ঠিত হন, আর দূরে রহিয়া দূরবীন লাগাইয়া কৌতুক দেখেন –কিন্তু সমস্ত দেশের বৃহৎ হৃদয়ের সহিত ও রক্তবহ নাড়ীর সহিত এই চেষ্টাহীন উদ্যমের ষে চিরন্তন সংযোগ আছে, এ কালের বহুচেষ্টাজাত বৃহৎ আয়োজনের সহিত সেরূপ সংযোগ কুত্ৰাপি দেখা যায় না। গোড়াতেই একটা পার্থক্য এই যে, এ কালের “বিরাট “ শিল্পপ্রদর্শনী বা কারুকার্য্যপ্রদর্শনী—যাহার পূৰ্ব্বে ন্যাশনাল বা জাতীয় বা ভারতীয়, এইরূপ একটা কিছু বিশেষণ দেওয়া অবশ্যকৰ্ত্তব্য বলিয়। গণ্য হয়—তাহাতে প্রবেশলাভের জন্য অন্ততঃ চারে আন দর্শনী দেওয়া অত্যাবশ্বক । চারি আনার টিকিট খরিদ করিতে যে হতভাগ্য অসমর্থ— জাতীয় প্রদর্শনীর প্রবেশদ্বার তাহার জন্য' অর্গলকুদ্ধ রহিয়াছে এবং তাহার দ্বারদেশে পুলিশ অথবা ভলণ্টিয়ার অৰ্দ্ধচন্দ্ৰ লইয়া উপবিষ্ট থাকে। আর সে কালে মেলার আয়তন যত ক্ষুদ্র হউক, অথবা বিপুল হউক,—বিধাতার নীল চন্দ্রাতপের নিম্নে যাহার —ধনী দরিদ্র, অন্ধ খঞ্জ, সকলেরই জন্য তাহা সৰ্ব্বদা মুক্ত আছে, কোনরূপ প্রাচীরের বেষ্টনী দিয়া তাহাকে ঘেরিয়া রাখিতে কেহ কখনও কল্পনায়ও আনে না। চারি আনা হাতে লইয়া না গেলে যেখানে দরিদ্র ব্যক্তি প্রবেশাধিকার পাইবে না, প্রত্যুত তাহাকে অপমানিত হইয়া ফিরিতে হইবে, সেখানে যেমনই প্রলোভন ও যেমনই আকর্ষণ থাক না কেন, মানব-সমাজের হৃৎপিণ্ড আন্দোলিত হইয়। সেখানে রক্তধারা পাঠায় না বা সেখান হইতে শোণিতধারা বাহির হইয়া সমস্ত সমাজের স্বায়ুকে স্পন্দিত বা পেশীকে পুষ্ট করিতে পারে না। কাজেই আকস্মিক ঢঙ্কানিনাদে ও চক্রঘর্ঘরধ্বনিতে শ্রবণেন্দ্রিয়ে যতই আঘাত লাগুক, স্থায়ী ফল তুলনা করিতে গেলে উভয়ের মধ্যে অনেকটা পার্থক্য আসিয়া দাড়ায়। যন্ত্রযোগে কোন মহৎ কার্য্য সম্পন্ন হয় না বা সম্পন্ন হইতে পারে না, এমন কথ। যদি আমি বলিতে যাই, তাহা হইলে পাঠকের আমাকে গগুমুখের দলে ফেলিবেন। ঐ বিশেষণে বিশিষ্ট হইতে আদৌ ইচ্ছা করি না। যন্ত্র জিনিসটা কৃত্রিম, উহাকে চেষ্টাপূৰ্ব্বক গড়িতে হয় ও অনবরত সচেষ্ট থাকিয়া চালাইতে হয় , চেষ্টার কোন একটা ক্রটি হইলে যন্ত্র বিকল হয়, ভাঙ্গিয়া যায় ; এমন কি বিপদ পর্য্যস্ত টানিয়া আনে। যন্ত্র চালাইতে হইলে বাহির হইতে ব্যয়সাধ্য ইন্ধনের জোগাড় করিতে হয়, সহসা ইন্ধনের অভাব ঘটলে সমুদয় যন্ত্র অচল হইয় পড়ে। এই সমস্ত দোষ থাকিলেও এই বিংশ শতাব্দীতে যন্ত্রের যুগে—যন্ত্রের শক্তি অপলাপ করিয়া দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিতে প্রস্তুত নহি । অন্য দেশের ব্যবস্থা অন্যরূপ, কিন্তু এ দেশে যন্ত্রবদ্ধ উদ্যম সবে আরম্ভ হইয়াছে , আশা করি, এই উদ্যম ক্রমে প্রসার ও পরিপুষ্টি লাভ করিবে এবং এই উদ্যমের ফলে দেশেরও শক্তি-সামর্থ্য ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইবে । আমার অভিপ্রায় এই যে, এই যন্ত্রমাহায্যে মুগ্ধ হইয়। আমরা যেন এ দেশের প্রাচীন উদ্যম অনুষ্ঠানগুলি,—যাহা কেহ চালায় না, যাহা আপনা হইতে চলে, যাহার পরিচালনের জন্য কেহ এক কড়া কড়ি ব্যয় করে না বা পাচ মিনিট মাথা ঘামায় না—যাহা কোন বীজ হইতে উৎপন্ন, অঙ্কুরিত ও বদ্ধিত হইয়। বৎসরের পর বৎসর ও শতাব্দীর পর শতাব্দী কাল সমান ভাবে চলিতেছে—যাহা বটবৃক্ষের মত বহু পুরুষের পতন উত্থান দেখিবার জঙ্ক ধাড়াইয়া আছে, মাহ চারিদিকে শাখাপল্লব বিস্তার করিয়া রহিয়াছে, যাহার
পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/১৬
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।