পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যন্ত্রবদ্ধ শিক্ষাপ্রণালী సె শেষ পর্য্যস্ত সামাজিক স্বার্থেরও প্রতিকূল হয়। ইহাই পাশ্চাত্য সমাজের নীতি এবং এক হিসাবে ইহা সন্নীতি, সন্দেহ নাই। এই নীতি মানিয়া লইলে আপন হইতে ইহাই প্রতিপন্ন হয় যে, দানধৰ্ম্ম সৰ্ব্বত্র ধৰ্ম্ম নহে। বিখ্যাত দার্শনিক হার্বট স্পেন্সার যিনি ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের পক্ষপাতী ছিলেন, তিনি আপন গবর্মেন্টের নিকটও দান গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন না। রাষ্ট্রের স্বার্থ যখন প্রজার স্বার্থ হইতে অভিন্ন, তখন প্রজা মাত্রকেই সরকারী ব্যয়ে বিদ্যাদান করিয়া রাষ্ট্রহিতে সমর্থ করিয়া তুলিতে পারিলে রাষ্ট্রেরই লাভ ; অতএব রাষ্ট্রের ব্যয়ে প্রজামাত্রেরই বিদ্যাশিক্ষাব্যবস্থা উচিত,—এই নীতি আজকাল পাশ্চাত্য দেশে গৃহীত হইতেছে বটে। কিন্তু স্পেন্সারের মত পণ্ডিতগণের ইহাতেও ঘোর আপত্তি। যে বিদ্যালাভ করিতে চায়, সে বিদ্যালাভের ব্যয় বহন করুক ; রাষ্ট্রের অর্থ—যাহ তাহার নিজস্ব অর্থ নহে, যাহা প্রজাসাধারণের অর্থ—তাহাতে ভাগ বসাইবার তাহার অধিকার নাই। পরের ছেলেকে লেখাপড় শেখাইবার জন্য অন্য পাচ জনে ত্যাগ স্বীকার করিবে, এরূপ ব্যবস্থা অনুচিত ; ইহা অস্বাভাবিক। এইরূপে স্বাতন্ত্র্যের ব্যাঘাত জন্মাইয়া পরতন্ত্রতার প্রশ্রয় দিলে শেষ পর্য্যন্ত রাষ্ট্রেরই—সমাজেরই স্বার্থহানি অবশ্যম্ভাবী। বলা উচিত, স্বাতন্ত্র্যানুকূল বিনিময় ব্যাপারে অভ্যস্ত হইয়াও স্বাতন্ত্র্যবাদের এই চরম পরিণতি আধুনিক স্বাতন্ত্রাবাদী ইউরোপও পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করিতে পারেন নাই । সে যাহাই হউক, যে লাভ চায়, সে তাহার মূল্য দিবে, এই নীতি স্থূলতঃ পাশ্চাত্য সমাজ গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু ভারতবর্ষের নীতি ইহার বিপরীত । এই নীতির অনুষ্ঠানে যে লেন-দেন, বিনিময়, দোকানদারির ভাব আসে, তাহা ভারতবর্ষের ধাতুর সহিত মিলে না। ভারতবর্ষীয় নীতির সমর্থন করিবার এ স্থান নহে। সে সময় বা সে প্রবৃত্তি আমার নাই ; কিন্তু ভারতবর্ষ এই দোকানদারিতে চিরকাল কুষ্ঠিত ; ভারত বর্ষের ইহাই স্বভাব | ভালই হউক, আর মন্দই হউক, ভারতবর্যের সমাজতত্ত্বের ইহা একটা মূল সুত্র। ইহা মানিয়া না লইলে ভারতবর্ষের অনেক সামাজিক প্রথার তাৎপৰ্য্য বুঝা যায় না। সমাজের মধ্যে বণিগ বৃত্তির অস্তিত্ব থাকিবেই; সকল সমাজেই থাকিবে। ভারতবর্ষের সমাজেও ইহা আছে ; কিন্তু ভারতবর্ষ এই বণিগ বৃত্তির প্রতি পক্ষপাত দেখাইতে সঙ্কুচিত। এ দেশে ধনীর গৃহে কোন উৎসব সমারোহের অনুষ্ঠান হইলে সেখানে ইতর সাধারণের জন্য দ্বার অবারিত থাকে, কাহাকেও দ্বারদেশে টিকিট দেখাইতে হয় না—পাড়ার লোকে চাদ করিয়া বারোয়ারির যাত্রা দিলেও সেখানে টিকিটের ব্যবস্থা হয় না । এ দেশে মেলা বসিলে, দর্শনী দিয়া তাহ দেখিতে হয় না। গৃহস্থের বাড়ী ভোজ হইলে অনাহূত ও রবাহত সমান আদরে আহূতগণের সহিত এক পঙক্তিতে ভোজনে বসে। এ দেশে যে বস্তু যত আদরের, সেই বস্তুর দানে ততই গৌরব এবং সেই বস্তুর জন্য মূল্য প্রার্থনা ততই অগৌরবের বিষয়। একটা দৃষ্টান্তে বুঝা যাইবে। এ দেশের শাস্ত্রে চিকিৎসা ব্যবসায়ের প্রতি কিছু অবজ্ঞা প্রকাশ আছে ; সমাজের শীর্ষে অবস্থিত ব্রাহ্মণ চিকিৎসা ব্যবসায় অবলম্বন করিতে এ দেশে সাহসী হন নাই। শাস্ত্রকে নিন্দা করিবার এখানে একটা প্রচুর অবসর হইয়াছে। সে দিন এক মাসিক পত্রিকায় এ জন্য হিন্দু সমাজের নিন্দাও দেখিলাম। ব্যাধিতের ব্যাধি মোচন—মমুষ্যের প্রাণদান যে ব্যবসায়ের মুখ্য উদ্বেগু, সেই ব্যবসায়ের অবজ্ঞা—