শব্দকথা : ধ্বনি-বিচার ©ፃ ‘অং-টুকু তখনও চলিতেছে। এই ট-টুকু কৰ্কশ, কিন্তু ‘অং-টুকু বেশ মধুর। শব্দশাস্ত্রে বলে, ঐ ‘চং' শব্দটার মধ্যে দ্বিবিধ ধ্বনি আছে ; একটা ব্যঞ্জনবর্ণের ধ্বনি, আর একটা স্বরবর্ণের ধ্বনি। ঢং-এর অন্তর্গত ক্ষণস্থায়ী 'ট' টুকু ব্যঞ্জনবর্ণ, আর স্থায়ী অংটুকু স্বরবর্ণ। ঐ ব্যঞ্জনটুকু কৰ্কশ, আর স্বরটুকু মধুর। কঠিন দ্রব্যের আঘাতে ঐ অচিরস্থায়ী ব্যঞ্জনটার জন্ম ; উহার স্থিতিকাল এত অল্প যে, পরবর্তী অং’-টুকু উহাতে যুক্ত না হইলে উহা শুনিতে পাইতাম কি না সন্দেহ । ‘ট বর্ণের ধ্বনিটা ঘড়ির পিঠে হাতুড়ির স্পর্শকালে উদ্ভূত হয় , ঐ স্পর্শকালেই উহার উৎপত্তি হয় ; এই জন্য উহাকে স্পর্শবর্ণের ধ্বনি বলা যাইতে পারে। আমাদের বাগ যন্ত্র অনেকটা বঁাশীর মত। ফুসফুস হইতে প্রশ্বাসের বায়ু মুখকোটরে আসিবার সময় কণ্ঠনালীর পথে অবস্থিত পেশী-নিৰ্ম্মিত দুইটা তারে আঘাত দিয়া ঐ তার ফুটাকে র্কাপাইয়া দেয় এবং সেই তারের কম্পে মুখকোটরের বায়ুমধ্যে ঢেউ জন্মে। সেই ঢেউগুলি মুখকোটর হইতে বাহিরে আসিয়া কর্ণগত হইলে ধ্বনি শোনা যায় । বাহির হইবার সময়" কোথাও কোন বাধা ব৷ আটক ন পাইয়। বাহির হইলে উহা স্বরবর্ণের ধ্বনির উৎপাদন করে ; আর কোন স্থানে আটক পাইলে ব্যঞ্জনবর্ণের ধ্বনির উৎপাদন করে। মুখ ব্যাদান করিয়া, মুখকোটর বিবৃত করিয়া আমরা , স্বরবর্ণের উচ্চারণ করি, আর ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণের সময় বহির্গমনোন্মুখ বায়ুকে, মুখকোটর হইতে বাহির হইবার সময়ে, কোন একটা স্থানে আটকাইয়া ফেলি। কণ্ঠতন্ত্রী কাপাষ্টয়া কণ্ঠনালী হইতে বায়ু মুখকোটরে আসিতেছে ; এমন সময়ে ক্ষণেকের মত জিহবার গোড়াটাকে উপরে তুলিয়া কণ্ঠের দুয়ার আটকাইয়া দিলাম, আর ধ্বনি বাহির হইল ‘ক’ ; উহা ব্যঞ্জনবর্ণ ; জিহ্বামূলের স্পর্শকালে উহার উৎপত্তি, কাজেই উহা জিহ্বামূলীয় স্পর্শবর্ণ। জিহবার মধ্যভাগ তালুতে স্পর্শ করিয়া বাতাস আটকাইলাম, আর ধ্বনি বাহির হইল 'চ'; উহ। তালব্য স্পর্শবর্ণ। জিহবার ডগাটা উন্টাইয়া উপরে তুলিয়া তালুর পশ্চাতে যেখানটাকে মূৰ্দ্ধা বলে, সেইখানে এক ঠোকর দিলাম, আর ধ্বনি হইল ট'; উহ মূৰ্দ্ধন্ত স্পর্শবর্ণ। জিহ্বার অগ্রভাগ উপর পাটির দাতে ঠেকাইয়া বাতাসটা আটকাইবা মাত্র, ধ্বনি জন্মিল ‘ত, উহা দন্ত্য স্পর্শবর্ণ। আর দুই ঠোট পরস্পর স্পর্শ করিয়া তাহার মধ্য দিয়া জোরে বাতাস ছাড়িয়া দিলাম; অমনি ধ্বনি জন্মিল 'প',উহা ওষ্ঠ্য স্পর্শবর্ণ। - নরকণ্ঠে ষে যে ধ্বনি নির্গত হয়, নরকষ্ঠ ব্যতীত অন্যত্রও তৎসদৃশ ধ্বনি জন্মিতে পারে। পূৰ্ব্বে বলিয়াছি, নরকষ্ঠ অনেকটা বাণীর মত; বাণীর ভিতর হইতে বায়ু অব্যাহতভাবে অর্থাৎ কোথাও আটক ন পাইয়া বাহির হইলে যে ধ্বনি জন্মে, উহ স্বরের ধ্বনি; এই ধ্বনিকে যত ক্ষণ ইচ্ছ। রাখিতে পারা যায়। সেই বায়ুর পথ রোধ করিলে ক্ষণস্থায়ী ব্যঞ্জনের উৎপত্তি হয়। কঠিন বস্তুর পরস্পর স্পর্শ বা সংঘট এই ব্যঞ্জনধ্বনির উৎপাদনের অনুকূল। যথা, কঠিন ইস্পাতে নির্মিত কাচি দিয়া কঠিন ধাতুনিৰ্ম্মিত তার কাটলে শব্দ হয় ‘কট ; কাঠে কাঠে আঘাতে শৰ হয় ঠ ক’ ; পথের উপর পদশব্দ ‘দ প’ ইত্যাদি।
পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪১
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।