বঙ্গলক্ষ্মীর ব্ৰতকথা ৩ সাত সমুদ্র পার হয়ে থষ্টান ইংরেজ সদাগর বাঙলায় বাণিজ্য করতে এসেছিল। দিল্লীর বাদশা তাদের আদর ক'রে নিজের রাজ্যমধ্যে জায়গা দিয়েছিলেন। বাঙলার ধন দেখে, ধান দেখে তাদের লোভ হ’ল । লক্ষ্মী তখন আলমগিরের বংশের দিল্লীর বাদশাকে ছেড়েছেন। বাদশা ইংরেজকে বাঙলার দেওয়ান করে দিলেন। বাদশার দশা দেখে বাদশাকে খাজনা দেওয়া বন্ধ ক’রে তারাই হ’ল বাঙলার রাজা । তারা এসেছিল সদাগর, হয়েছিল বাদশার দেওয়ান, হয়ে গেল দেশের রাজা। রাজা হ’ল ; কিন্তু রাজ্যে বাস করল না। বাঙলাদেশের ধন নিয়ে ধান নিয়ে সাত সমুদ্রপারে আপন দেশে চল ল । সাগরের জাত কিনা, মেজাজ ঠাণ্ডা, তীক্ষ্ম বুদ্ধি, অতিশয় ধূৰ্ত্ত। তার চোরডাকাত দমন কর্ল, মিষ্টি মিষ্টি কথা কইতে লাগল, আবার নিজের দেশ হ'তে খেলনা এনে পুতুল এনে প্রজার মন ভুলাতে লাগল। লক্ষ্মী যখন চঞ্চল হন, তখন মানুষের বুদ্ধিলোপ হয়। বাঙলার লোকের বুদ্ধিলোপ হ’ল। বুড়ামানুষে শিশু সাজ ল , ইংরেজের দেওয়া খেলনা-পুতুল নিয়ে ছেলেখেলা করতে লাগল। সদাগর রাজা কাচ এনে দিলেন। বাঙলার প্রজা কাঞ্চনবদলে সেই র্কাচ নিতে লাগল। দেশের জিনিষে লোকের মন উঠে না। ঝু টোমণির রঙ দেখে দেশের সাচ্চামণিকে অনাদর করতে লাগল। রাজা যত আদর দেন, সোহাগ করেন, দেশের লোক ততই খোকা সাজতে লাগল। রাজা হাততালি দিতে লাগলেন , দেশের যত বুড়ে হামাগুড়ি দিয়ে আধ-আধ কথা বলতে লাগল। লক্ষ্মী বললেন—আর না, আমি বাঙলার লক্ষ্মী, বাঙলার লোকের এই দশা, আমার আর বাঙলায় থাকা চললো না । লক্ষ্মী চঞ্চল। চঞ্চল হয়ে বাঙলার লক্ষ্মী বাঙলা ছেডে চললেন । আঁধার রাতে কালপেচা ডেকে উঠল। তথন সাত কোটি বাঙালী কেঁদে উঠল। রাজার দোষে লক্ষ্মী আমাদের ছেডে চল লেন বলে রাজার দোষ দিয়ে সকলে কেঁদে উঠল। ইংরেজ রাজা সেই কাদন শুনে বিরক্ত হ’লেন। ই-বেজ রাজার তখন একটা ছোকরা নায়েব ছিল , সে আপন দেশে ছিল কেরাণী, হয়ে এসেছিল নায়েব । নায়েবী পেয়ে সে ধরাকে সর জ্ঞান করত। আলমগির বাদশার তত্তে বসে সে আপনাকে আলমগিরের নীতি ঠাওরা’ত। সে বললে এরা বড় ঘ্যানঘ্যান করছে ; থাকৃ, এদের দু-দল ক’রে দিচ্ছি, এক দিকে যাকৃ মোছলমান, এক দিকে থাকৃ হিন্দু। এরা ভাই-ভাই একঠাই থেকে বড় বিরক্ত করছে ; এদের ভাই-ভাই ঠাই-ঠাই ক’রে দাও, এদের জোট ভেঙ্গে দাও। এই বলে তিনি বাঙালীকে দু-দল ক’রে দিলেন, – এক দিকে গেল হি দু এক দিকে গেল মোছলমান। পূর্ব-উত্তরে গেল মোছলমান, পশ্চিমে-দক্ষিণে থাকুল হিছ। লক্ষ্মী দেখলেন, আমি বাঙলার লক্ষ্মী ; আর আমার নিতান্তই বাঙলায় থাকা চলল না। আমার হিন্দু যেমন, মোছলমান তেমনি। হিন্দু মোছলমান যখন ভাই-ভাই ঠাই-ঠাই হ’ল, তখন আর আমার বাঙলায় থাকা চলল না। ১৩১২ সাল, আশ্বিন মাসের তিরিশে, সোমবার কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়া, সে দিন বড় দুদিন, সেই দিন রাজার হুকুমে বাঙলা ভূ-ভাগ হবে ; দু-ভাগ দেখে বাঙলার লক্ষ্মী বাঙলা ছেড়ে যাবেন । পাচ কোটি বাঙালী আছাড় খেয়ে ভূমে গড়াগড়ি দিয়ে ডাকতে লাগল – মা, তুমি বাঙলার লক্ষ্মী, তুমি বাঙলা ছেড়ে যেয়ে না, আমাদের অপরাধ ক্ষমা কর ; বিদেশী রাজা আমাদের স্বখ দুঃখ বোঝেন না ; তাই ভাই-ভাই ঠাই ঠাই
পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৭
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।