পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মতিচূর:প্রথম খণ্ড ১১

পিপাসা নিবৃত্ত হয় সলিল—কৃপায়,
বল হে জলধি! তব পিপাসা কোথায়?

 আবার তাহার গভীর গর্জনে শুনিলাম, “পিপাসা, পিপাসা”! হায়! এই পােড়া পিপাসার জ্বালায় আমি দেশান্তরে পলাইয়া আসিলাম, এখানেও ঐ নিষ্ঠুর কথাই শুনিতে পাই। চক্ষ মুদ্রিত করিলাম—ঐ তরঙ্গে তরঙ্গে আর পিপাসা দেখিতে ইচ্ছা ছিল না। সমুদ্র আবার গম্ভীর গর্জন করিল। এবারও তাহার ভাষা বুঝিলাম,—স্পষ্ট শুনিলাম,—“পিপাসা, পিপাসা”।

 “পিপাসা পিপাসা'—মুখ মানব! জান না এ কিসের পিপাসা? কোথায় শুনিয়াছ সাগরের পিপাসা নাই? এ হৃদয়ের দুর্দান্ত পিপাসা কেমন করিয়া দেখাইব? আমার হৃদয় যত গভীর, পিপাসাও তত প্রবল! এ সংসারে কাহার পিপাসা নাই? পিপাসা পিপাসা—এইটুকু বুঝিতে পার না? ধনীর ধন-পিপাসা, মানীর মান-পিপাসা, সংসারীর সংসার-পিপাসা। নলিনীর তপন-পিপাসা, চকোরীর চন্দ্রিকা-পিপাসা! অনলেরও তীব্র পিপাসা আছে! আহা! এই মােটা কথা বুঝ না? পিপাসা না থাকিলে ব্রহ্মাণ্ড ঘুরিত কি লক্ষ্য করিয়া? আমার হৃদয়ে অনন্ত প্রণয়-পিপাসা,—যতদিন আছি, পিপাসাও থাকিবে! প্রেমিকের প্রেম-পিপাসা, প্রকৃতির ঈশ্বর-পিপাসা! এইটুকু কি বুঝিতে পার না? * * *”

 তাই বটে, এত দিনে বুঝিলাম, আমার হৃদয় কেন সদা হু হু করে, কেন সদা কাতর হয়। এ হৃদয়ের পিপাসা তুচ্ছ বারি পিপাসা নহে। ইহা অনন্ত প্রেম-পিপাসা। ঈশ্বর একমাত্র বাঞ্ছনীয়, আর সকলে পিপাসী-ঐ বাঞ্ছনীয় প্রেমময়ের প্রেম-পিপাসী!!

 আমি তবে বাতুল নহি। আমি যে পিপাসা দেখি, তাহা সত্য— কল্পিত নহে! আমি যে পিপাসা শুনি, তাহাও সত্য-কল্পনা নহে। ঈশ্বর প্রেম, এ বিশ্বজগৎ প্রেম-পিপাসু।


স্ত্রীজাতির অবনতি

পাঠিকাগণ! আপনারা কি কোন দিন আপনাদের দুর্দশার বিষয় চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন? এই বিংশ শতাব্দীর সভ্যজগতে আমরা কি? দাসী। পৃথিবী হইতে দাস ব্যবসায় উঠিয়া গিয়াছে শুনিতে পাই, কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি? না। আমরা দাসী কেন?—কারণ আছে।[১]

 আদিমকালের ইতিহাস কেহই জানে না বটে; তবু মনে হয় যে পুরাকালে যখন সভ্যতা ছিল না, সমাজবন্ধন ছিল না, তখন আমাদের অবস্থা এরূপ ছিল না। কোন অজ্ঞাত


  1. কেহ কেহ বলিতে পারেন, যে, নারী নরের অধীন থাকিবে, ইহা ঈশ্বরেরই অভিপ্রেত-তিনি প্রথমে পুরুষ সৃষ্টি করিয়াছেন, পরে তাহার সেবা শুশ্রুষার নিমিত্ত নারীর সৃষ্টি হয়। কিন্তু এগুলে আমরা ধর্ম্মগ্রন্থের কোন মতামত লইয়া আলােচনা করিব না-কেবল সাধারণের সহজ বুদ্ধিতে যা বুঝা যায়, তাহাই বলিব। অর্থাৎ স্বকীয় মত ব্যক্ত করিতেছি মাত্র।