পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩২ রোকেয়া রচনাবলী

নিজেকে অতি তুচ্ছ মনে করি। অনেক সময় “হাজার কোক ব্যাটা ছেলে!” বলিয়া ব্যাটা ছেলেদের দোষ ক্ষমা করিয়া অন্যায় প্রশংসা করি। এই ত ভুল।[১]

 আমি ভগিনীদের কল্যাণ কামনা করি, তাঁহাদের ধর্ম্মবন্ধন বা সমাজবন্ধন ছিন্ন করিয়া তাহাদিগকে একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে বাহির করিতে চাহি না। মানসিক উন্নতি করিতে হইলে হিন্দুকে হিন্দুত্ব বা খ্রীষ্টানকে খ্রীষ্টানী ছাড়িতে হইবে এমন কোন কথা নাই। আপন আপন সম্প্রদায়ের পার্থক্য রক্ষা করিয়াও মনটাকে স্বাধীনতা দেওয়া যায়। আমরা যে কেবল উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে অবনত হইয়াছি, তাই বুঝিতে ও বুঝাইতে চাই।

 অনেকে হয়ত ভয় পাইয়াছেন যে, বোধ হয় একটা পত্নীবিদ্রোহের আয়োজন করা হইতেছে। অথবা ললনাগণ দলে দলে উপস্থিত হইয়া বিপক্ষকে রাজকীয় কার্য্যক্ষেত্র হইতে তাড়াইয়া দিয়া সেই পদগুলি অধিকার করিবেন—শামলা, চোগা, আইন কানুনের পাঁজি পুঁথি লুঠিয়া লইবেন! অথবা সদলবলে কৃষিক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া কৃষকগুলিকে তাড়াইয়া দিয়া। তাহাদের শস্যক্ষেত্র দখল করিবেন, হাল গরু কাড়িয়া লইবেন, তবে তাহাদের অভয় দিয়া বলিতে হইবে—নিশ্চিন্ত থাকুন।

 পুরুষগণ আমাদিগকে সুশিক্ষা হইতে পশ্চাৎপদ রাখিয়াছেন বলিয়া আমরা অকর্ম্মণ্য হইয়া গিয়াছি। ভারতে ভিক্ষু ও ধনবান—এই দুই দল লোক অলস; এবং ভদ্রমহিলার দল কর্তব্য অপেক্ষা অল্প কাজ করে। আমাদের আরাম-প্রিয়তা খুব বাড়িয়াছে। আমাদের হস্ত, পদ, মন, চক্ষু ইত্যাদির সদ্ব্যবহার করা হয় না। দশজন রমণীর একত্র হইলে ইহার উহার—বিশেষতঃ আপন আপন অর্ধাঙ্গের নিন্দা কিংবা প্রশংসা করিয়া বাক্‌পটুতা দেখায়। আবশ্যক হইলে কোন্দলও চলে।

 আশা করি এখন “স্বামী” স্থলে “অর্দ্ধাঙ্গ” শব্দ প্রচলিত হইবে।

সুগৃহিণী

ইতঃপূর্বে আমি “স্ত্রীজাতির অবনতি” প্রবন্ধে আমাদের প্রকৃত অবস্থার চিত্র দেখাইতে প্রয়াস পাইয়াছি কিন্তু সত্য কথা সর্ব্বদাই কিঞ্চিৎ শ্রুতিকটু বলিয়া অনেকে উহা পছন্দ করেন নাই।[২] অতঃপর “অর্ধাঙ্গী” প্রবন্ধে আমি দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি যে, নারী ও নর উভয়ে একই বস্তুর অঙ্গবিশেষ। যেমন একজনের দুইটি হাত কিংবা কোন শকটের দুইটি চক্র,


  1. এস্থলে জনৈক নারীহিতৈষী মহাত্মার উর্দু গাথা মনে পড়িল। তিনি (১৯০৫ খৃষ্টাব্দের কোন মাসিক পত্রিকায় লিখিয়াছেন, “জগতে তোমাদের নিন্দাগীতি এত দূর উচ্চরণে গাওয়া গিয়াছে যে শষে তোমরা ও জগতের কথায় বিশ্বাস করিয়া ভাবিলে যে আমরা বাস্তবিক বিদ্যালতের উপযুক্ত নহি। সুতরাং মূখতার কুফল ভোগের নিমিত্ত তোমরা নত মস্তকে প্রস্তুত হইলে।” কি চমৎকার সত্য কথা। জগদীশ্বর উক্ত কবিকে দীর্ঘজীবী করুন!
  2. কেহ আবার প্রতিবাদ করিতে যাইয়া সগর্বে বলিয়াছেন “ভারতে হিন্দুর আরাধ্য দেবতা নাবী, তাহার নারীরই উপাসক।” বেশ! বলি হিন্দুর আরাধ্য দেবতা কোন্ জিনিষটি নহে? পূজনীয় বস্তু বলিতে চেতুন, অচেতুন, উদ্ভিদ ইহার কান্ পদার্থটিকে বাদ দেওয়া যায়? হনুমান এবং গোজাতিও কি উপাস্য দেবতা নহে? তাই বলিয়া কি ঐ সকল পককে তাঁহাদের উপাসক মানুষ” অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলা হইয়া থাকে?