পাতা:রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪২ রোকেয়া রচনাবলী

স্বাভাবিক, কিন্তু মানুষে সুবিধার জন্য গাড়ী, পাল্কী প্রভৃতি নানাপ্রকার যানবাহন প্রস্তুত করিয়াছে। সঁতার দিয়া জলাশয় পার হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু মানুষে নানাবিধ জলযান প্রস্তুত করিয়াছে। তাহার সাহায্যে সঁতার না জানিলেও অনায়াসে সমুদ্র পার হওয়া যায়। ঐরূপ মানুষের অস্বাভাবিক” সভ্যতার ফলেই অন্তঃপুরের সৃষ্টি।

 পৃথিবীর অসভ্য জাতীরা অৰ্দ্ধ-উলঙ্গ অবস্থায় থাকে। ইতিহাসে জানা যায়, পূর্বে অসভ্য ব্রিটনেরা অর্ধনগ্ন থাকিত। ঐ অর্ধনগ্ন অবস্থার পূর্বে গায় রঙ মাখিত! ক্রমে সভ্য হইয়া তাহারা পােষাক ব্যবহার করিতে শিখিয়াছে।

 এখন সভ্যতাভিমানিনী (Civilized) ইউরােপীয় এবং ব্রাহ্মসমাজের ভগ্নীগণ মুখ ব্যতীত সর্ব্বাঙ্গ আবৃত করিয়া হাটে মাঠে বাহির হন। আর অন্যান্য দেশের মুসলমানেরা (ঘরের বাহির হইবার সময় মহিলাদের মুখের উপর আরও একখণ্ড বাবরণ (বােরকা) দিয়া ঐ অঙ্গাবরণকে সম্পূর্ণ উন্নত (perfect) করিয়াছেন। যাহারা বােরকা ব্যবহার করেন না, তাহারা অবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকেন। কেহ কেহ বােরকা ভারী বলিয়া আপত্তি করেন। কিন্তু তুলনায় দেখা গিয়াছে ইংরাজ মহিলাদের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হ্যাট অপেক্ষা আমাদের বােরকা অধিক ভারী নহে।

 পর্দা অর্থে ত আমরা বুঝি গােপন করা বা হওয়া, শরীর ঢাকা ইত্যাদি—কেবল অন্তঃপুরের চারি-প্রাচীরের ভিতর থাকা নহে। এবং ভালমতে শরীর আবৃত না করাকেই “বে-পর্দা” বলি। যাহারা ঘরের ভিতর চাকরদের সম্মুখে অর্ধ-নগ্ন অবস্থায় থাকেন, তাহাদের অপেক্ষা যাহারা ভালমতে পােষাক পরিয়া মাঠে বাজারে বাহির হন, তাহাদের পর্দা বেশী রক্ষা পায়।

 বর্ত্তমান যুগে ইউরােপীয়া ভগ্নীগণ সভ্যতার চরম সীমায় উঠিয়াছেন; তাঁহাদের পর্দা নাই কে বলে? তাহাদের শয়নকক্ষ, এমনকি বসিবার ঘরেও কেহু বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করেন। এ প্রথা কি দোষণীয়? অবশ্য নহে। কিন্তু এদেশের যে ভগ্নীরা বিলাতী সভ্যতার অনুকরণ করিতে যাইয়া পর্দা ছাড়িয়াছেন, তাহাদের না আছে ইউরােপীয়াদের মত শয়নকক্ষের স্বাত (bedroom privacy) না আছে আমাদের মত বােরকা!

 কেহ বলিয়াছেন যে “সুন্দর দেহকে বােরকা জাতীয় এক কদর্য ঘােমটা দিয়া আপাদমস্তক ঢাকিয়া এক কিম্ভুত কিমাকার জীব সাজা যে কি হাস্যকর ব্যাপার যাহারা দেখিয়াছেন, তঁহারাই বুঝিতে পারিয়াছেন” ইত্যাদি। তাহা ঠিক। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস যে রেলওয়ে প্লটফরমে দাড়াইয়া কোন সম্রান্তু মহিলাই ইচ্ছা করেন না যে তাহার প্রতি দর্শকবৃন্দ আকৃষ্ট হয়। সুতরাং ঐরূপ কুৎসিত জীব সাজিয়া দর্শকের ঘৃণা উদ্রেক করিলে কোন ক্ষতি নাই। বরং কুলকামিনীগণ মুখমণ্ডলের সৌন্দর্য দেখাইয়া সাধারণ দর্শকমণ্ডলীকে আকর্ষণ করাই দোষণীয় মনে করিবেন।

 ইংরাজী আদব কায়দা (etiquette)ও আমাদিগকে এই শিক্ষা দেয় যে ভদ্রমহিলাগণ আড়ম্বররহিত (simple) পােষাক ব্যবহার করিবেন—বিশেষতঃ পদব্রজে ভ্রমণ কালে চাকচিক্যময় বা আঁকজমক-বিশিষ্ট কিছু ব্যবহার করা তাহাদের উচিত নহে।[১]


  1. ঐ উপদেশে আমরা কোরাণ শরীফের অষ্টাদশ “পারার “সুরা নূরের একটি উক্তির প্রতিধ্বনি শুনিতে পাই। যথা-“বিশ্বাসী স্ত্রীলােকদিগকে বল, তাহারা যেন দৃষ্টি সতত নীচের দিকে রাখে (অর্থাৎ চঞ্চল