পাতা:লোকসাহিত্য - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

3 е লোকসাহিত্য গ্রাম্যসাহিত্যের মধ্যেও কল্পনার তান অধিক থাকৃ বা না-থাকৃ সেই আনন্দের স্বর অাছে। গ্রামবাসীরা যে জীবন প্রতিদিন ভোগ করিয়া আসিতেছে, যে কবি সেই জীবনকে ছন্দে তালে বাজাইয়া তোলে সে কবি সমস্ত গ্রামের হৃদয়কে ভাষা দান করে। পদ্মাচরের চক্রবাক-সংগীতের মতে: তাহা নিখুত স্থর-তালের অপেক্ষ রাখে না। মেঘদূতের কবি অলকা পর্যন্ত গিয়াছেন, তিনি উজ্জয়িনীর রাজসভার কবি । আমাদের অখ্যাত গানের কবি কঠিন দায়ে পড়িয়াও পাবনা শহরের বেশি অগ্রসর হইতে পারে নাই ; যদি পারিত তবে তাহার গ্রামের লোক তাহার সঙ্গ ত্যাগ করিত। কল্পনার সংকীর্ণতার দ্বারাই সে আপন প্রতিবেশীবর্গকে ঘনিষ্ঠস্থত্রে বঁাধিতে পারিয়াছে এবং সেই কারণেই তাহার গানের মধ্যে, কল্পনাপ্রিয় একক কবির নহে, পরস্তু সমস্ত জনপদের হৃদয় কলরবে ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। সেইজন্য বাংলা জনপদের মধ্যে ছড়া গান কথা-আকারে যে সাহিত্য গ্রামবাসীর মনকে সকল সময়েই দোল দিতেছে তাহাকে কাব্যহিসাবে গ্রহণ করিতে গেলে তাহার সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে সমস্ত গ্রাম, সমস্ত লোকালয়কে জড়াইয়া লইয়া পাঠ করিতে হয় ; তাহারাই ইহার ভাঙা ছন্দ এবং অপূর্ণ মিলকে অর্থে ও প্রাণে ভরাট করিয়া তোলে। গ্রাম্যসাহিত্য বাংলার গ্রামের ছবির, গ্রামের স্মৃতির অপেক্ষ রাখে ; সেইজন্যই বাঙালির কাছে ইহার একটি বিশেষ রস আসে। বৈষ্ণবী যখন ‘জয় ‘রাধে’ বলিয়া ভিক্ষা করিতে অস্তঃপুরের আঙিনায় আসিয়া দাড়ায় তখন কুতুহলী গৃহকত্রী এবং অবগুষ্ঠিত বধূগণ তাহ। শুনিবার জন্য উৎস্থক হইয়া আসেন। প্রবীণ পিতামহী, গল্পে গানে ছড়ায় যিনি আকণ্ঠ পরিপূর্ণ— কত শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্নায় ও কৃষ্ণপক্ষের তারার আলোকে তাহাকে উত্ত্যক্ত করিয়া তুলিয়া গৃহের বালকবালিকা যুবকযুবতী একাগ্রমনে বহু শত বৎসর ধরিয়া যাহা শুনিয়া আসিতেছে বাঙালি পাঠকের নিকট তাহার রস গভীর এবং অক্ষয় ।