পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (অষ্টম সম্ভার).djvu/২২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শরৎ-সাহিত্য-সংএই হাতে । তাহার নিজের হাতে থাকিলে কাটিত না । কিন্তু চরণ আর খেলাও করে না, কথাও কহে না । বৃন্দাবন তাহাকে কত রকমের মূল্যবান খেলনা কিনিয়া দিয়াছিল—নানাবিধ কলের গাড়ি, জাহাজ, ছবি-দেওয়া পশুপক্ষী—যে সমস্ত লইয়া ইতিপূৰ্ব্বে সে নিয়তই ব্যস্ত থাকিত, এখন তাহ ঘরের কোণে পড়িয়া থাকে, সে দিকেও চাহে না । সে-বিপদের দিনে এই শিশুর প্রতি লক্ষ্য করিবার কথাও কাহারো মনে হয় নাই । তাহার ঠাকুরমাকে যখন চাদর-চাপা দিয়া ঘাটে তুলিয়া বিকট হরিধ্বনি দিয়া লইয়া যায়, তখন সে তাহারই পাশে দাড়াইয়া ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়াছিল। কেন ঠাকুরমা তাহাকে সঙ্গে লইলেন না, কেন গরুর গাড়ির বদলে মাহুষের কাধে অমন করিয়া মুড়িগুড়ি দিয়া নিঃশব্দে চলিয়া গেলেন, কেন ফিরিয়া আলিতেছেন না, কেন বাবা এত কঁাদেন, ইহাই সে যখন তখন আপন মনে চিন্তা করে । তাহার এই হতাশ বিহ্বল বিষণ্ণ মূৰ্ত্তি সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করিল, করিল না শুধু তাহার পিতার। মায়ের আকস্মিক মৃত্যু বৃন্দাবনকে এমন আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল যে, কোনদিকে মনোযোগ করিবার, বুদ্ধিপূৰ্ব্বক চাহিয়া দেখিবার বা চিন্তা করিবার শক্তি তাহার মধ্যেই ছিল না। তাহার উদাস উদভ্ৰান্ত দৃষ্টির সম্মুখে যাহাই আসিত, তাহাই ভাসিয়া যাইত, স্থির হইতে পাইত না । এ-কয়দিন প্রত্যহ সন্ধ্যার সময় তাহার শিক্ষক দুর্গাদাসবাবু আসিয়া বসিতেন, কত-রকম করিয়া বুঝাইতেন , বৃন্দাবন চুপ করিয়া শুনিত বটে, কিন্তু অন্তরের মধ্যে কিছু গ্রহণ করিতে পারিত না । কারণ, এই একটা ভাব তাহাকে স্থায়ীরূপে গ্রাস করিয়া ফেলিয়াছিল যে, অকস্মাৎ অকুল সমুদ্রের মাঝখানে তাহার জাহাজের তলা ফাসিস্থা গিয়াছে, হাজার চেষ্টা করিলেও এ ভয়পোত কিছুতেই বন্দরে পৌছিবে না। শেষ পরিণতি যার সমুদ্রগর্তে, তাহার জন্য স্থাপাইয়া মরিয়া লাভ কি ! এমন না হইলে তাহার অমন স্ত্রী জীবনের সুর্য্যোদয়েই চরণকে রাখিয়া অপস্থত হইত না, এমন অসময়ে কুম্বমেরও হয়ত দয়া হইত, এত নিষ্ঠুর হইয়া চরণকে পরিত্যাগ করিতে পারিত না । এবং সকলের উপর তাহার মা । এমন মা কে কবে পায় ? তিনিও যেন স্বেচ্ছায় বিদায় হইয়া গেলেন,--যাইবার সময় কথাটি পৰ্য্যস্ত কহিয়া গেলেন না। এমনি করিয়া তাহার বিপৰ্য্যন্ত মস্তিষ্কে বিধাতার ইচ্ছা যখন প্রত্যহ স্পষ্ট হইতে স্পষ্টতর হইয়া দেখা দিতে লাগিল, তখন বাড়ির পুরাতন দাসী আসিয়া কঁদে কাদ হইয়া নালিশ করিল, দাদা, শেষকালে ছেলেটাকেও কি হারাতে হবে ? একবার তাকে তুমি কাছে ডাকো না, আদর কর না, চেয়ে দেখ দেখি, কি রকম হয়ে গেছে । - তাহার কথাগুলো লাঠির মত বৃন্দাবনের মাথায় পড়িয়া তন্ত্রার ঘোর ভাঙিয়া ২১৮