পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (চতুর্থ সম্ভার).djvu/২৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শরৎ-সাহিত্য-সংগ্ৰহ বাড়িতে শাশুড়ী এখনও বাচিয়া আছেন বটে, কিন্তু বড়বন্ধু সিদ্ধেশ্বরীই যথার্থ গৃহিণী । তাহার প্রকৃতিটা বুঝা যাইত না, এইজন্যই বোধ করি পাড়ায় তাহার অখ্যাতি-মুখ্যাতি দুইই একটু অতিমাত্রায় ছিল। সিদ্ধেশ্বরীর দরিদ্র পিতামাতা এখনও বাচিয়া ছিলেন । গত পাঁচ-ছয় বৎসর ধরিয়া তাহারা অবিশ্রাম চেষ্টা করিয়া এবার পূজার সময় মেয়েকে বাড়ি লইয়া গিয়াছিলেন । সিদ্ধেশ্বরী সংসার ফেলিয়া বেশীদিন সেখানে থাকিতে পারিলেন না, মাসখানেক পরেই ফিরিয়া আসিলেন, কিন্তু কাটোয়ার ম্যালেরিয়া সঙ্গে করিয়া আনিলেন। অথচ, বাড়ি আসিয়া অত্যাচার বন্ধ করিলেন না । তেমনিই প্রাতঃস্নান চলিতে লাগিল এবং কিছুতেই কুইনিন সেবন করিতে সম্মত হইলেন না । অতএব ভূগিতেও লাগিলেন । দুই-চারিদিন যায় জত্বে পড়েন, আবার উঠেন, আবার পড়েন। ফলে, দুর্বল হইয়া পড়িতেছিলেন—এমন সময় শৈল বাপের বাড়ি হইতে ফিরিয়া আসিয়া চিকিৎসা সম্বন্ধে অত্যন্ত কড়াকড়ি করিয়া দিল । ছেলেবেলা হইতে চিরকাল সে বড়বধুর কাছেই আছে, এজন্য সে যত জোর করিতে পারিত, মেজবোঁ কিম্বা আর কেহ তাহ পারিত না । আরও একটা কারণ ছিল । মনে মনে সিদ্ধেশ্বরী তাহাকে ভারী ভয় করিতেন। শৈল অত্যন্ত রাগী মানুষ এবং এমনি কঠোর উপবাস করিতে পারিত যে, একবার শুরু করিলে কোন উপায়েই তাহাকে জলস্পর্শ করানো যাইত না এইটাই সিদ্ধেশ্বরীর সর্বাপেক্ষ উৎকণ্ঠার হেতু ছিল। শৈলর মাসীর বাড়ি পটলডাঙ্গায় । এবার কৃষ্ণনগর হইতে আসিয়া অবধি তাহাদের সহিত দেখা করিতে পারে নাই। আজ একাদশী, শাশুড়ীর রান্নার কাজ নাই—তাই সকালেই সিদ্ধেশ্বরীর মেজ ছেলে হরিচরণের উপর মাকে ঔষধ খাওয়াইবার ভার দিয়া সে পটলডাঙ্গায় গিয়াছিল । শীতকাল। ঘণ্টা-দুই হইল সন্ধ্যা হইয়াছে। কাল প্রভাত হইতে সিদ্ধেশ্বরীর ভালো করিয়া জর ছাড়ে নাই। আজ এই সময়টায় তিনি লেপ মুড়ি দিয়া চুপ করিয়া নিজীবের মত র্তাহার অতি-প্রশস্ত শয্যার একাংশে শুইয়া ছিলেন । এবং এই শয্যার উপরেই তিন-চারটি ছেলেমেয়ে চেচামেচি করিয়া খেলা করিতেছিল। নীচে কানাইলাল প্রদীপের আলোকের সন্মুখে বসিয়া ভূগোল মুখস্থ করিতেছিল—অর্থাৎ বই খুলিয়া স্থা করিয়া ছাড়াছড়ি দেখিতেছিল। ওধারে শয্যার উপর হরিচরণ শিয়রে আলো জালিয়া চিত হইয়া নিবিষ্টচিত্তে বই পড়িতেছিল। বোধ করি পাশের পড়া তৈরি করিতেছিল, কারণ এত গণ্ডগোলেও তাহার লেশমাত্র ধৈর্ধ্যচ্যুতি ঘটিতেছিল