পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (নবম সম্ভার).djvu/৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কমল কহিল, সেদিনও এমনি বুড়োই ছিলেন। দেহে নয়, মনে। এক এক জন থাকে যারা বুড়ে মন নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন। সেই বুড়ো শাসনের নীচে তাদের শীর্ণ বিকৃত যৌবন চিরদিন লজ্জায় মাথা হেঁট করে থাকে। বুড়ো মন খুশি হয়ে বলে, আহ ! এই ত বেশ! হাঙ্গামা নেই, মাতামাতি নেই—এই ত শান্তি, এই ত মামুষের চরম তত্ত্বকথা । তার কত রকমের কত ভাল ভাল বিশেষণ, কত বাহবার ঘটা । দুই কান পূর্ণ করে তার খ্যাতির বাদ্য বাজে, কিন্তু এ যে তার জীবনের জয়বাদ্য নয়, আনন্দলোকের বিসর্জনের বাজনা এ-কথা সে জানতেও পারে না । সকলেই মনে মনে চাহিলেন ইহার একটা কড়া রকমের জবাব দেওয়া প্রয়োজন— মেয়েমানুষের মুখ দিয়া উন্মাদযৌবনের এই নির্লজ্জ স্তব-গানে সকলের কানের মধ্যেই জালা করিতে লাগিল, কিন্তু জবাব দিবার মত কথাও কেহ খুজিয়া পাইলেন না। তখন আপ্তবাবু মৃদু-কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, কমল, বুড়ে মন তুমি কাকে রল ? দেখি নিজের সঙ্গে একবার মিলিয়ে এ সত্যিই কি না । কমল কহিল মনের বাৰ্দ্ধক্য আমি তাকেই বলি আশুবাবু, যে মন সুমুখের দিকে চাইতে পারে না, যার অবসন্ন জরা-গ্রস্ত মন ভবিষ্যতের সমস্ত আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে কেবল অতীতের মধ্যেই বেঁচে থাকতে চায়। আর যেন তার কিছু করবার, কিছু পাবারই দাবি নেই–বর্তমান তার কাছে লুপ্ত, অনাবশ্বক, অনাগত অর্থহীন। অতীতই তার সর্বস্ব। তার আনন্দ, তার বেদনা—সেই তার মূলধন। তাকেই ভাঙিয়ে খেয়ে সে জীবনের বাকি দিন-কটা টিকে থাকতে চায়। দেখুন ত আপ্তবাবু, নিজের সঙ্গে একবার মিলিয়ে । আপ্তবাবু হাসিলেন, বলিলেন, সময়মত একবার দেখব বই কি । অজিতকুমার এতক্ষণের এত কথার মধ্যে একটি কথাও বলে নাই, শুধু নিম্পলক চক্ষে কমলের মুখের প্রতি চাহিয়াছিল, সহসা কি যে তাহার হইল, সে আপনাকে আর সামলাইতে পারিল না, বলিয়া উঠিল, আমার একটা প্রশ্ন—দেখুন মিসেস্— কমল সোজা তাহার দিকে চাহিয়া বলিল, মিসেস কিসের জন্য ? আমাকে আপনি কমল বলেই ডাকুন না ? অজিত লজ্জায় রাঙা হইয়া উঠিল—ন না, সে কি, সে কেমনধারা যেন— কমল কহিল, কিছুই কেমনধারা নয়। বাপ-মা আমার নাম রেখেচেন আমাকে ডাকবার জন্যেই ত। ওতে আমি রাগ করিনে। অকস্মাৎ মনোরমার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, আপনার নাম মনোরমা, তাই বলে যদি আমি ডাকি আপনি রাগ করেন নাকি ? 83