পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (পঞ্চম সম্ভার).djvu/৩১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাল্য-স্মৃতি

যাইতে হইল। যাইবার সময় ঠাকুর্দ্দাকে প্রণাম করিয়া মনে মনে বলিলাম, হরি কালই যেন তোমার শ্রাদ্ধে বাড়ি ফিরে আসি। তারপর আমাকে কে কলকাতায় পাঠায় দেখে নেবো।

 আমি এই প্রথম কলিকাতায় আসিলাম। এতবড় জমকাল সহর পূর্ব্বে কখনও দেখি নাই। মনে ভাবিলাম, যদি এই প্রকাণ্ড গঙ্গার উপরে কাঠের সাঁকোর মাঝামাঝি, কিংবা ঐ যেখানে একরাশ মাস্তুল খাড়া করিয়া জাহাজগুলা দাঁড়াইয়া আছে, সেই বরাবর যদি একবার তলাইয়া যাই, তাহা হইলে আর কখনও বাড়ি ফিরিয়া যাইতে পারিব না। কলিকাতায় আমার একটুও ভাল লাগিল না। এত ভয়ে কি আর ভালবাসা হয়? কখনও যে হইবে—সে ভরসাও করিতে পারিলাম না।

 কোথায় গেল আমাদের সেই নদীর ধার, সেই বাঁশঝাড়, মাঠের মধ্যে বেলগাছ, মিত্তিরদের বাগানের এক কোণের জামরুল গাছ, কিছুই নাই। শুধু বড় বড় বাড়ি, বড় বড় গাড়ি, ঘোড়া আর লোকজনে ঠেসাঠেসি পেযাপেষি, বড় বড় রাস্তা—বাড়ির পিছনে এমন একটি বাগান নাই যে, লুকাইয়া একছিলিম তামাক খাই। আমার কান্না আসিল। চোখের জল মুছিয়া মনে মনে বলিলাম, ভগবান জীবন দিয়েচেন—আহার তিনিই দেবেন। কলিকাতায় স্কুলে ভর্ত্তি হইয়াছি, ভাল করিয়া পড়াশুনা করি, কাজে কাজেই আমি আজকাল ভাল ছেলে। দেশে অবশ্যই আমার নাম জাহির হইয়া গিয়াছে—যাক সে-কথা।

 আমরা আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব মিলিয়া একটা মেস করিয়া আছি। আমাদের মেসে চারজন লোক। সেজদাদা, আমি, রামবাবু ও জগন্নাথবাবু। রামবাবু ও জগন্নাথবাবু সেজদাদার বন্ধু। এতদ্ভিন্ন একজন ভূত্য ও একজন পাচক ব্রাহ্মণ আছে। গদাধর আমাদের রসুয়ে ব্রাহ্মণ। সে আমা অপেক্ষা তিন-চারি বৎসরের বড় ছিল। অমন ভালমানুষ লোক আমি কখনও দেখি নাই। পাড়ার কোনও ছেলের সহিত আমার আলাপ ছিল না। সম্পূর্ণ বিভিন্ন প্রকৃতির লোক হইলেও সে আমার মস্ত বন্ধু হইয়া উঠিল। তাঁহাতে আমাতে যে কত গল্প হইত তার ঠিকানা ছিল না। তাহার বাড়ি মেদিনীপুর জেলার একটা গ্রামে। সেখানকার কথা, তাহার বাল্য-ইতিহাস ইত্যাদি শুনিতে আমার বড় ভাল লাগিত। সে-সব কথা আমি এতবার শুনিয়াছি যে, আমার বোধ হয় আমাকে সেখানে চোখ বাঁধিয়া

৩১৩
৫ম—৪০