পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (পঞ্চম সম্ভার).djvu/৩২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শরৎ-সাহিত্য-সংগ্রহ

ছাড়িয়া দিলেও সমস্ত স্থানটি স্বচ্ছদে ঘুরিয়া বেড়াইতে পারি। রবিবারে তাহার সহিত আমি গড়ের মাঠে বেড়াইতে আসিতাম। সন্ধ্যাবেলায় রান্নাঘরে বসিয়া খিল দিয়া দুইজনে বিন্তি খেলিতাম। ভাত খাইয়া তার ছোট হুঁকোটিতে দুইজনে তামুক খাইতাম। সব কাজ আমরা দুইজনে করিতাম। পাড়ার কাহারও সহিত আলাপ নাই; সঙ্গী, দোস্ত, ইয়ার, বন্ধু, মুচিপাড়ার ভূলো, কেলে, খোকা, খাদা সবই আমার সে; তাহার মুখে আমি কখনও উঁচু কথা শুনি নাই। মিছামিছি সবাই তাহাকে তিরস্কার করিত; আমার গা জ্বালা করিত, কিন্তু সে কোনও কথার উত্তয় দিত না—যেন যথার্থই দোষ করিয়াছে।

 সকলকে আহার করাইয়া সে যখন রান্নাঘরের কোণে একটি ছোট থালায় খাইতে বসিত, তখন আমার শতকর্ম্ম থাকিলেও সেখানে উপস্থিত হইতাম। বেচারীর ভাগ্যে প্রায় কিছুই থাকিত না; এমন কি, ভাত পর্য্যন্ত কম পড়িত। কাহারো খাইবার সময় আমি থাকি নাই—খাইতে বসিয়া ভাত কম পড়ে, তরকারী কম পড়ে, মাছ কম পড়ে, আমি আগে কখনই দেখি নাই। আমার কেমন বোধ হইত।

 ছেলেবেলায় ঠাকুরমা মধ্যে মধ্যে দুঃখ করিয়া বলিতেন, ছেলেটা আধপেটা খেয়ে খেয়ে শুকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে—আর বাঁচবে না। আমি কিন্তু ঠাকুরমার ভরপেট কিছুতেই খাইতে পারিতাম না। শুকাইয়া যাই, আর দড়ি হইয়াই যাই, আমার আধপেটাই ভাল লাগিত। এখন কলিকাতায় আসিয়া বুঝিয়াছি, সে আধপেটায় এ আধপেটায় অনেক প্রভেদ। কেহ খাইতে না পাইলে যে চোখে জল আসিয়া পড়ে, আমি পূর্ব্বে কখনও অনুভব করি নাই। পূর্ব্বে কতবার ঠাকুর্দ্দার পাত্রে উচ্ছিষ্ট জল দিয়া তাঁহাকে আহার করিতে দিই নাই; ঠাকুরমার গায়ে সারমেয় সন্তান নিক্ষেপ করিয়া তাঁহার উপস্থিত কর্ম্ম হইতে তাঁহাকে বিরত করিয়াছি। তাঁহাদের আহার হয় নাই; কিন্তু চোখে কখনও জল আসে নাই। পিতামহপিতামহী আপনার লোক—গুরুজন, আমাকে স্নেহ করেন—তাঁহাদের জন্য কখনও দুঃখ হয় নাই; স্ব-ইচ্ছায় তাহাদিগকে অৰ্দ্ধভূক্ত, এমন কি, অভুক্ত রাখিয়া পরম সন্তোষ লাভ করিয়াছি। আর এই গদাধর কোথাকার কে—তাহার জন্য অনাহূত অশ্রু আপনি আসিয়া পড়ে।

 কলিকাতায় আসিয়া যে আমার কি হইল তাহা ঠাওরাইতে পারি না। চোখে এত জলই বা কোথা হইতে আসে ভাবিয়া পাই না। আমাকে কেহ কাঁদিতে দেখে নাই। জিদ করিয়া আস্ত খেজুরের ছড়ি আমার পৃষ্ঠে ভগ্ন করিয়াও বাল্যকালে গুরুমহাশয় তাঁহার সাধ পূর্ণ করিতে পারেন নাই। ছেলেরা বলিত, সুকুমারের গা ঠিক পাথরের মত। আমি মনে মনে বলিতাম, গা পাথরের মত নয়—মন পাথরের

৩১৪