পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (প্রথম সম্ভার).djvu/১৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দত্তা

তাহার কতক প্রায়শ্চিত্ত করিব। তোমার দয়াতেই আমি উকিল হইয়া সুখে আছি, এ-কথা কোন দিন ভুলি নাই।’

বনমালী তাহার উত্তরে লিখিলেন, ‘বেশ। তোমার ছেলের দীর্ঘজীবন কামনা করি। কিন্তু আমার মেয়ে হওয়ার কোন আশাই নাই। তবে, যদি কোন দিন মঙ্গলময়ের আশীর্ব্বাদে সন্তান হয়, তোমাকে দিব।’ চিঠি লিখিয়া বনমালী মনে-মনে হাসিল। কারণ বছর-দুই পূর্ব্বে তাহার অপর বন্ধু রাসবিহারীর যখন ছেলে হয়, সেও ঠিক এই প্রার্থনাই করিয়াছিল। বাণিজ্যের কৃপায় সে এখন মস্ত ধনী। সবাই তাহার মেয়েকে ঘরে আনিতে চায়।


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ


দুমাস-ছয়মাসের কথা নয়, পঁচিশ বৎসরের কাহিনী বলিতেছি। বনমালী প্রাচীন হইয়াছেন। কয়েক বৎসর হইতে রোগে ভুগিয়া ভুগিয়া এইবার শয্যা আশ্রয় করিয়া টের পাইয়াছিলেন, আর বোধ হয় উঠিতে হইবে না। তিনি চিরদিনই ভগবৎপরায়ণ ও ধর্ম্মভীরু। মরণে তাঁহার ভয় ছিল না। শুধু একমাত্র সন্তান বিজয়ার বিবাহ দিয়া যাইবার অবকাশ ঘটিল না মনে করিয়াই কিছু ক্ষুণ্ণ ছিলেন। সেদিন অপরাহ্ন-কালে হঠাৎ বিজয়ার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে লইয়া বলিয়াছিলেন, মা, আমার ছেলে নেই বলে আমি এতটুকু দুঃখ করি নে। তুই আমার সব। এখনো তোর আঠারো বৎসর বয়স পূর্ণ হয়নি বটে, কিন্তু তোর এইটুকু মাথার উপর আমার এত বড় বিষয়টা রেখে যেতেও আমার এক বিন্দু ভয় হয় না। তোর মা নেই, ভাই নেই, একটা খুড়ো-জ্যাঠা পর্য্যন্ত নেই। তবু আমি নিশ্চয় জানি, আমার সমস্ত বজায় থাকবে। শুধু একটা অনুরোধ ক’রে যাই মা, জগদীশ যাই করুক, আর যাই হোক, সে আমার ছেলেবেলার বন্ধু। দেনার দায়ে তার বাড়িঘর কখনো বিক্রী ক’রে নিস্ নে। তার একটি ছেলে আছে—তাকে চোখে দেখিনি, কিন্তু শুনেছি, সে বড় সৎ ছেলে। বাপের দোষে তাকে নিরাশ্রয় করিস্ নে মা, এই আমার শেষ অনুরোধ।

বিজয়া অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে কহিলেন, বাবা, তোমার আদেশ আমি কোন দিন অমান্য কর্‌ব না। জগদীশবাবু যতদিন বাঁচবেন, তাঁকে তোমার মতই মান্য করব; কিন্তু তাঁর অবর্ত্তমানে, সমস্ত বিষয় মিছামিছি তাঁর ছেলেকে কেন ছেড়ে দেব? তাঁকে তুমিও কখনো চোখে দেখনি, আমিও দেখিনি। আর যদি সত্যিই তিনি লেখাপড়া শিখে থাকেন, অনায়াসেই ত পিতৃ-ঋণ শোধ করতে পারবেন।

১৮১