পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (সপ্তম সম্ভার).djvu/৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গৃহদাই বলিয়া আবার নির্নিমেষ-চক্ষে চাহিয়া রহিল। অচলা ভীত হইয়া উঠিল। সুরেশের মুখের উপর কি একপ্রকার শুষ্ক পাণ্ডুরতা–কপালের শির দুটে রক্তে স্ফীত, চোখ দুটো জল জল করিতেছে—যেন কি একটা সে ছো মারিয়া ধরিতে চায়। একে এই গরম, তাহাতে এত বেলা পৰ্য্যন্ত স্নানাহার নাই—গত রাত্রে এতটুকু ঘুমাইতে পারে নাই—তাহার পায়ের নীচের মাটিটা পৰ্য্যন্ত যেন অকস্মাৎ দুলিয়া উঠিল। আরক্ত দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিল, ব্রাহ্মদের ঘৃণা করি কি না, সে জবাব ব্রাহ্মদের দেব, কিন্তু আপনি আমার কাছে তাদের অনেক অনেক উপরে— তাহার উন্মাদ ভঙ্গীতে অচলা ভয়ে কাঠ হইয়া উঠিল। কোনমতে প্রসঙ্গটা চাপ দিবার জন্য সভয়ে কহিতে গেল, বেয়ারাটা— কিন্তু সে অস্ফুট মৃত্নস্বর সুরেশের উত্তপ্ত উচ্চ কণ্ঠে ঢাকা পড়িয়া গেল। সে অমনি তীব্রস্বরে কহিতে লাগিল, দুটো দিনের পরিচয় । তা বটে ! কিন্তু জানো অচলা, দিন, ঘণ্টা, মিনিট দিয়ে মহিমকে মাপা যায়—কিন্তু সুরেশকে যায় না । সে স্থানকালের অতীত। তুমি ভূমিকম্প দেখেচ ? যা পৃথিবী গ্রাস করে-- অচলা ব্যাধভীত হরিণীর মত চক্ষের পলকে উঠিয়া দাডাইয়া কহিল, আপনার স্বানের যোগাড়–, বলিয়া পা বাড়াইতেই সুরেশ সহসা সম্মুখে ঝুকিয়া পড়িয়া অচলার ডান হাত ধরিয়া টান দিল । সেই উন্মত্ত ও আকস্মিক আকর্ষণ সহ করা স্ত্রীলোকের সাধ্য নয়। সে উপুড় হইয়া সুরেশের গায়ের উপর আসিয়া পড়িল। ভয় ও বিস্ময় অতিক্রম করিয়া তাহার অর্তিকণ্ঠের অস্ফুট ‘মা গো ! আহবান তাহার কম্পিত ওষ্ঠপুট ত্যাগ করিতে না করিতে স্বরেশ তাহার দুই হাত নিজের বুকের উপর সজোরে টানিয়া লইয়া ডাকিল, অচলা ! অচলা চোখ তুলিয়া মূৰ্ছিত মায়ামুগ্ধের মত চাহিয়া রহিল এবং বেশও ক্ষণকালের জন্য কথা কহিতে পারিল না—শুধু তাহার অপরিমেয়, পিপাসাদগ্ধ ওষ্ঠাধর হইতে কেমন যেন একটা স্তব্ধ তীব্র জালা ছড়াইয়া পড়িতে লাগিল । কয়েক মুহূর্ত এইভাবে থাকিয়া সুরেশ আর একবার অচলার দুই হাত বুকের উপর চাপিয়া ধরিয়া উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিতে লাগিল, আচল, একটিবার ভূমিকম্পের এই প্রচণ্ড হৃৎস্পন্দন নিজের দুটি হাতে অনুভব করে দেখ—কি ভীষণ তাণ্ডব এই বুকের ভেতরটায় তোলপাড় করে বেড়াচ্চে। এ কি পৃথিবীর কোন ভূমিকম্পের চেয়ে ছোট ? বলতে পার অচলা, পৃথিবীতে কোন জাতি, কোন ধৰ্ম্ম, কোন মতামত আছে, যা এই বিপ্লবের মধ্যে পড়েও ডুবে রসাতলে তলিয়ে যাবে না! ছেড়ে দিন-বাবা আসচেন, বলিয়া জোর করিয়া নিজকে মুক্ত করিয়া লইয়া অচলা তাহার চোঁকিতে ফিরিয়া গিয়া শান্ত হইয়া বসিল এবং পরক্ষণেই কেদারবাবু ২৭