পাতা:শান্তিনিকেতন (১৯৩৪ প্রথম খণ্ড)-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০৮
শান্তিনিকেতন

একটি মিলনের ক্ষেত্র—নইলে এখানকার এত সাজসজ্জা একেবারেই বাহুল্য।

 জগতে হৃদয়েরও একটা বোঝবার বিষয় আছে, সে কথা একেবারে উড়িয়ে দিলে চলবে কেন? এক দিকে আলোক আছে বলেই আমাদের চক্ষু আছে, এক দিকে সত্য আছে বলেই আমাদের চৈতন্য আছে, এক দিকে জ্ঞান আছে বলেই আমাদের বুদ্ধি আছে— তেমনি আর-এক দিকে কী আছে আমাদের মধ্যে হৃদয় হচ্ছে যার প্রতিরূপ? উপনিষৎ এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন: রসোবৈ সঃ। তিনি হচ্ছেন রস, তিনিই আনন্দ।

 পূর্বেই আভাস দিয়েছি, আমরা শক্তির দ্বারা প্রয়োজন সাধন করতে পারি, যুক্তির দ্বারা জ্ঞান লাভ করতে পারি, কিন্তু, আনন্দের সম্বন্ধে শক্তি এবং যুক্তি কেবল দ্বার পর্যন্ত এসে ঠেকে যায়— তাদের বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এই আনন্দের সঙ্গে একেবারে অন্তঃপুরের সম্বন্ধ হচ্ছে ইচ্ছার। আনন্দে কোনোরকম জোর খাটে না— সেখানে কেবল ইচ্ছা, কেবল খুশি।

 আমার মধ্যে এই ইচ্ছার নিকেতন হচ্ছে হৃদয়। আমার সেই ইচ্ছাময় হৃদয় কি শূন্যে প্রতিষ্ঠিত, তার পুষ্টি হচ্ছে মিথ্যায়, তার গম্য স্থান হচ্ছে ব্যর্থতার মধ্যে? তবে এই অদ্ভুত উপসর্গটা এল কোথা থেকে, একমুহূর্ত আছে কোন্ উপায়ে? জগতের মধ্যে কি কেবল একটিমাত্রই ফাঁকি আছে? এবং সেই ফাঁকিটিই আমার এই হৃদয়?

 কখনোই নয়। আমাদের এই ইচ্ছারসময় হৃদয়টি জগদ‍্ব্যপী ইচ্ছারসের নাড়ীর সঙ্গে বাঁধা—সেইখান থেকেই সে আনন্দরস পেয়ে বেঁচে আছে, না পেলে তার প্রাণ বেরিয়ে যায়; সে অন্নবস্ত্র চায় না, বিদ্যাসাধ্য চায় না, অমৃত চায়, প্রেম চায়। যা চায় তা ক্ষুদ্ররূপে সংসারে এবং চরমরূপে তাঁতে আছে বলেই চায়— নইলে কেবল রুদ্ধ দ্বারে মাথা খুঁড়ে মরবার জন্যে তার সৃষ্টি হয় নি।