পাতা:শান্তিনিকেতন (১৯৩৪ প্রথম খণ্ড)-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পার্থক্য
১১৭

কিছু রূপ তা আনন্দরূপ, অর্থাৎ মূর্তিমান ইচ্ছা; ইচ্ছা আপনাকে সীমায় বেঁধেছে, রূপে বেঁধেছে।

 প্রকৃতিতে ঈশ্বর নিয়মের দ্বারা, সীমার দ্বারা যে পার্থক্য সৃষ্টি করে দিয়েছেন সে যদি কেবলমাত্রই পার্থক্য হত তা হলে জগৎ তো সমষ্টিরূপ ধারণ করত না। তা হলে অসংখ্য বিচ্ছিন্নতা এমনি বিচ্ছিন্ন হত যে কেবলমাত্র সংখ্যাসূত্রেও তাদের একাকারে জানবার কিছুই থাকত না।

 অতএব, এর মধ্যে আর-একটি জিনিস আছে যা এই চিরন্তন পার্থক্যকে চিরকালই অতিক্রম করছে। সেটি কী? সেটি হচ্ছে শক্তি। ঈশ্বরের শক্তি এই-সমস্ত পার্থক্যের উপর কাজ করে একে এক অভিপ্রায়ে বাঁধছে। সমস্ত স্বতন্ত্র নিয়মবদ্ধ দাবাবড়ের ঘুঁটির মধ্যে একই খেলোয়াড়ের শক্তি একটি এক-তাৎপর্য-বিশিষ্ট খেলাকে অভিব্যক্ত করে তুলছে।

 এইজন্যেই তাঁকে ঋষিরা বলেছেন ‘কবিঃ’। কবি যেমন ভাষার স্বাতন্ত্র্যকে নিজের ইচ্ছার অধীনে নিজের শক্তির অনুগত করে সুন্দর ছন্দোবিন্যাসের ভিতর দিয়ে একটি আশ্চর্য অর্থ উদ্ভাবিত করে তুলছে তিনিও তেমনি ‘বহুধাশক্তিযোগাৎ বর্ণাননেকান্ নিহিতার্থোদধাতি’, অর্থাৎ, শক্তিকে বহুর মধ্যে চালিত ক’রে, বহুর সঙ্গে যুক্ত ক’রে, অনেক বর্ণের ভিতর থেকে একটি নিহিত অর্থ ফুটিয়ে তুলছেন— নইলে সমস্তই অর্থহীন হত।

 ‘শক্তিষোগাৎ’, শক্তিযোগের দ্বারা। শক্তি একটি যোগ। এই যোগের দ্বারাই ঈশ্বর সীমার দ্বারা পৃথক‍্কৃত প্রকৃতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন; নিয়মের সীমারূপ পার্থক্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে তাঁর শক্তি দেশের সঙ্গে দেশান্তরের, রূপের সঙ্গে রূপান্তরের, কালের সঙ্গে কালান্তরের বহুবিচিত্র সংযোগ সাধন ক’রে এক অপূর্ব বিশ্বকাব্য সৃজন করে চলেছে।