পাতা:শান্তিনিকেতন (১৯৩৪ প্রথম খণ্ড)-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

তপোবন *。 প্রভুত্ব করাকেই, ভোগ করাকেই, সে শ্রেষ্ঠতার প্রধান লক্ষণ ব’লে মানে না। মামুষের শ্রেষ্ঠতার সর্বপ্রধান পরিচয়ই হচ্ছে এই যে, মাহব সকলের সঙ্গে মিলিত হতে পারে। সে মিলন মুঢ়তার মিলন নয় ; সে মিলন চিত্তের মিলন, স্বতরাং আনন্দের মিলন । এই আনন্দের কথাই আমাদের কাব্যে কীর্তিত। উত্তরচরিতে রাম ও সীতার যে প্রেম, সেই প্রেম আনন্দের প্রাচুর্যবেগে চারি দিকের জলস্থল-আকাশের মধ্যে প্রবেশ করেছে। তাই রাম দ্বিতীয়বার গোদাবরীর গিরিতট দেখে বলে উঠেছিলেন : যত্র দ্রুমা অপি মূগা অপি বন্ধবো মে। তাই সীতাবিচ্ছেদকালে তিনি তাদের পূর্বনিবাসভূমি দেখে আক্ষেপ করেছিলেন যে, ‘মৈথিলী তার করকমলবিকীর্ণ জল নীবার ও তৃণ দিয়ে যে-সকল গাছ পাখি ও হরিণদের পালন করেছিলেন তাদের দেখে আমার হৃদয় পাষাণ গলার মতো গলে যাচ্ছে।’ মেঘদূতে যক্ষের বিরহ নিজের দুঃখের টানে স্বতন্ত্র হয়ে একলা কোণে বসে বিলাপ করছে না। বিরহদুঃখই তার চিত্তকে নববর্ষায় প্রফুল্ল পৃথিবীর সমস্ত নগনদী-অরণ্যনগরীর মধ্যে পরিব্যাপ্ত করে দিয়েছে। মানুষের হৃদয়বেদনাকে কবি সংকীর্ণ করে দেখান নি, তাকে বিরাটের মধ্যে বিস্তীর্ণ করেছেন ; এইজন্যই প্রভুশাপগ্রস্ত একজন যক্ষের দুঃখবার্তা চিরকালের মতো বৰ্ষাঋতুর মর্মস্থান অধিকার করে প্রণয়ীহৃদয়ের খেয়ালকে বিশ্বসংগীতের ধ্রুপদে এমন করে বেঁধে দিয়েছে। ভরতবর্ষের এইটেই হচ্ছে বিশেষত্ব। তপস্যার ক্ষেত্রেও এই দেখি, যেখানে তার হৃদয়বৃত্তির লীলা সেখানেও এই দেখতে পাই। মানুষ দুই রকম করে নিজের মহত্ব উপলব্ধি করে— এক, স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে ; আর-এক, মিলনের মধ্যে । এক, ভোগের দ্বারা ; আর-এক, যোগের দ্বার। ভারতবর্ষ স্বভাবতই শেষের পথ অবলম্বন করেছে ।