পাতা:শান্তিনিকেতন (১৯৩৪ প্রথম খণ্ড)-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভাঙা হাট
৭৩

 কোনো গতিকে এই কাঠকুটো পাতালতা সংগ্রহ হয়েছিল। কিন্তু, আজ রাত্রি না যেতেই শুনতে পাচ্ছি, ‘ওরে, গাড়ি কোথায় রে, গোরু জোত রে।’ যেতে হবে, এবার গ্রামে যেতে হবে। এই চলে যাওয়ার প্রয়োজনটাই এখন সকলের বড়ো। কাল রাত্রিবেলাকার একান্ত প্রয়োজনগুলো আজ আবর্জনা হয়ে পড়ে রইল; কাল যাকে বলেছিল বড়ো দরকার আজ তাকে পরিত্যাগ করে যাবার জন্যে ব্যতিব্যস্ত।

 বিশ্বমানবও এমনি করেই এক যুগ থেকে আর-এক যুগে যাবার আয়োজন করছে। যখন নূতন প্রভাত উঠছে, যখন রাত ভোর হবে হবে করছে, তখন এ ওকে ঠেলাঠেলি করে ডাকছে, ‘ওরে, চল্‌ রে! ওরে, গোরু কোথায় রে! ওরে, গাড়ি কোথায়।’ তখন ওই রাত্রির অত্যন্ত প্রয়োজনের সামগ্রীগুলো এই দিনের আলোতে অত্যন্ত আবর্জনা হয়ে লজ্জিত হয়ে পড়ে রইল। শুকনো পাতা থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে, তার ছাইগুলো জমে উঠছে। ভাঙা হাঁড়ি-সরা-শালপাতায় মাঠ বিকীর্ণ। আশ্রয়গৃহগুলি আশ্রিতদের দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে অত্যন্ত শ্রীভ্রষ্ট ও লজ্জিত হয়ে আছে। সমস্তই রইল— পূর্ব-আকাশ রাঙা হয়ে উঠেছে, এবারে যাত্রা করে বেরোতে হবে। আবার, আবার আর-এক যুগের প্রয়োজন সংগ্রহ করতে হবে। তখন মনে হবে এইবারকার এই প্রয়োজনগুলিই চরম, আর-কোনোদিন ভোরের বেলায় গাড়িতে গোরু জুততে হবে না। এই বলে আবার কাঠকুটো-ডালপালা-সংগ্রহে প্রবৃত্ত হওয়া যায়। কিন্তু, তখনও এই অত্যন্ত একান্ত প্রয়োজনের দূর সম্মুখ দিগন্ত থেকে করুণ ভৈরবীসুরে বাণী আসছে, ‘প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই।’

 যদি এই সুরটুকু না থাকত, যদি এই অত্যন্ত প্রয়োজনের ভিতরেই অত্যন্ত অপ্রয়োজন বাস না করত, তা হলে কি আমরা বাঁচতে পারতুম? প্রয়োজন যদি সত্যই একান্ত হত তা হলে তার ভয়ংকর চাপ কে সহ্য