পাতা:শিক্ষা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০৬
শিক্ষা

তাপ দেয় বটে, কিন্তু দগ্ধ করে না। কালিদাস বসন্তপ্রকৃতির সর্বব্যাপী যৌবনলীলার মাঝখানে হরপার্বতীর মিলনচাঞ্চল্যকে নিবিষ্ট করে তার সম্ভ্রম রক্ষা করেছেন।

 অকালবসন্তসমাগমে বনস্থলীতে যখন অশোকের গাছে গুঁড়ি থেকে একেবারে পল্লব পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে ফুল ফুটে উঠল, সহকারের শাখা নতুন কিশলয়ে ছেয়ে গেল, তখন মধুকর তার প্রিয়ার সঙ্গে এক পুষ্পপাত্রে মধুপান করতে বসে গেল; কৃষ্ণসার হরিণ স্পর্শনিমীলিতাক্ষী মৃগীর গায়ে শিঙ দিয়ে কণ্ডূয়ন করে দিতে লাগল; তখন হস্তিনী পদ্মরেণুগন্ধি গণ্ডূষজল হস্তীকে পান করিয়ে দিলে এবং চক্রবাক আধখানা মৃণাল নিজে খেয়ে বাকি আধখানা চক্রবাকীকে খাইয়ে দিতে লাগল। এমনি ক’রে, কালিদাস পুষ্পধনুর জ্যানির্ঘোষকে বিশ্বসংগীতের সুরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন ও বেসুরো করে বাজান নি, যে পটভূমিকার উপরে তিনি তার ছবিটি এঁকেছেন সেটি তরুলতা-পশুপক্ষীকে নিয়ে সমস্ত আকাশে অতি বিচিত্র বর্ণে বিস্তারিত।

 কেবল তৃতীয় সর্গ নয়, সমস্ত কুমারসম্ভব কাব্যটিই একটি বিশ্বব্যাপী পটভূমিকার উপরে অঙ্কিত। এই কাব্যের ভিতরকার কথাটি একটি গভীর এবং চিরন্তন কথা। যে পাপদৈত্য প্রবল হয়ে উঠে হঠাৎ স্বর্গলোককে কোথা থেকে ছারখার করে দেয় তাকে পরাভূত করবার মতো বীরত্ব কোন্ উপায়ে জন্মগ্রহণ করে?

 এই সমস্যাটি মানুষের চিরকালের সমস্যা, প্রত্যেক লোকের জীবনের সমস্যাও এই বটে, আবার এই সমস্যা সমস্ত জাতির মধ্যে নূতন নূতন মূর্তিতে নিজেকে প্রকাশ করে।

 কালিদাসের সময়েও একটি সমস্যা ভারতবর্ষে অত্যন্ত উৎকট হয়ে দেখা দিয়েছিল, তা কবির কাব্য পড়লেই স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রাচীনকালে হিন্দুসমাজে জীবনযাত্রায় যে-একটি সরলতা ও সংযম ছিল তখন সেটি ভেঙে এসেছিল। রাজারা তখন রাজধর্ম বিস্মৃত হয়ে আত্মসুখপরায়ণ ভোগী হয়ে উঠেছিলেন।