পাতা:শিক্ষা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শিক্ষার বাহন
১৮১

 যাহা হউক, বিদ্যাশিক্ষার উপায় ভারতবর্ষে কিছু কিছু হইয়াছে, কিন্তু বিদ্যাবিস্তারের বাধা এখানে মস্ত বেশি। নদী দেশের এক ধার দিয়া চলে, বৃষ্টি আকাশ জুড়িয়া হয়। তাই ফসলের সব চেয়ে বড়ো বন্ধু বৃষ্টি, নদী তার অনেক নীচে; শুধু তাই নয়, এই বৃষ্টিধারার উপরেই নদীজলের গভীরতা বেগ এবং স্থায়িত্ব নির্ভর করে।

 আমাদের দেশে যাঁরা বজ্র হাতে ইন্দ্রপদে বসিয়া আছেন তাঁদের সহস্রচক্ষু, কিন্তু বিদ্যার এই বর্ষণের বেলায় অন্তত তার ৯৯০টা চক্ষু নিদ্রা দেয়। গর্জনের বেলায় অট্টহাস্যের বিদ্যুৎ বিকাশ করিয়া বলেন, বাবুগুলার বিদ্যা একটা অদ্ভুত জিনিস; তার খোসার কাছে তল্‌তল্‌ করে, তার আঁঠির কাছে পাক ধরে না। যেন এটা বাবুসম্প্রদায়ের প্রকৃতিগত। কিন্তু বাবুদের বিদ্যাটাকে যে প্রণালীতে জাগ্‌ দেওয়া হয় সেই প্রণালীতেই আমাদের উপরওয়ালাদের বিদ্যাটাকেও যদি পাকানোর চেষ্টা করা যাইত তবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রমাণ হইত যে, যে বিদ্যার উপরে ব্যাপক শিক্ষার সূর্যালোকের তাপ লাগে না তার এমনি দশাই হয়।

 জবাবে কেহ কেহ বলেন, ‘পশ্চিম যখন পশ্চিমেই ছিল, পূর্বদেশের ঘাড়ে আসিয়া পড়ে নাই, তখন তোমাদের টোলে চতুষ্পঠীতে যে তর্কশাস্ত্রের প্যাঁচ কষা এবং ব্যাকরণসূত্রের জাল বোনা চলিত সেও তো অত্যন্ত কুনোরকমের বিদ্যা।’ এ কথা মানি, কিন্তু বিদ্যার যে অংশটা নির্জলা পাণ্ডিত্য সে অংশ সকল দেশেই পণ্ড এবং কুনো, পশ্চিমেও পেডান্‌ট্রি মরিতে চায় না। তবে কিনা, যে দেশ দুর্গতিগ্রস্ত সেখানে বিদ্যার বল কমিয়া গিয়া বিদ্যার কায়দাটাই বড়ো হইয়া ওঠে। তবু এ কথা মানিতে হইবে, তখনকার দিনের পাণ্ডিত্যটাই তর্কচঞ্চু ও ন্যায়পঞ্চাননদের মগজের কোণে কোণে বদ্ধ ছিল বটে, কিন্তু তখনকার কালের বিদ্যাটা সমাজের নাড়ীতে নাড়ীতে সজীব ও সবল হইয়া বহিত। কি গ্রামের নিরক্ষর চাষি কি অন্তঃপুরের স্ত্রীলোক, সকলেরই মন নানা উপায়ে এই বিদ্যার সেঁচ পাইত। সুতরাং, এ জিনিসের মধ্যে অন্য অভাব অসম্পূর্ণতা যাই থাক্‌, ইহা নিজের মধ্যে সুসংগত ছিল।