পাতা:শ্রীকান্ত (প্রথম পর্ব).djvu/১১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১৩
শ্রীকান্ত

বালবিধবা হইয়াও যখন সূতিকা-রোগে আক্রান্ত হইয়া ছয় মাস ভুগিয়া ভুগিয়া মরেন, তখন সেই মৃত্যুশয্যার পাশে আমি ছাড়া আর কেহ ছিল না। বাগানের মধ্যে একখানি মাটীর ঘরে তিনি একাকিনী বাস করিতেন। সকলের সর্ব্বপ্রকার রোগে, শোকে, সম্পদে, বিপদে এতবড় সেবাপরায়ণা, নিঃস্বার্থ পরোপকারিণী রমণী পাড়ার মধ্যে আর কেহ ছিল না। কত মেয়েকে তিনি যে লেখাপড়া শিখাইয়া, সূচের কাজ শিখাইয়া, গৃহস্থালীর সর্ব্বপ্রকার দুরূহ কাজকর্ম শিখাইয়া দিয়া, মানুষ করিয়া দিয়াছিলেন, তাহার সংখ্যা নাই। একান্তস্নিগ্ধ, শান্তস্বভাব এবং সুনির্ম্মল চরিত্রের জন্য পাড়ার লোকও তাঁহাকে বড় কম ভালবাসিত না। কিন্তু সেই নিরুদিদির ত্রিশ বৎসর বয়সে হঠাৎ যখন পা-পিছলাইয়া গেল এবং ভগবান এই সুকঠিন ব্যাধির আঘাতে তাঁহার আজীবন উঁচু মাথাটি একেবারে মাটীর সঙ্গে একাকার করিয়া দিলেন, তখন পাড়ার কোন লোকই দুর্ভাগিনীকে তুলিয়া ধরিবার জন্য হাত বাড়াইল না। দোষস্পর্শ-লেশহীন নির্ম্মল হিন্দুসমাজ হতভাগিনীর মুখের উপরেই তাহার সমস্ত দরজা জানালা আঁটিয়া বন্ধ করিয়া দিলেন। সুতরাং সে পাড়ার মধ্যে এমন একটি লোকও বোধকরি ছিল না, যে, কোন-না-কোন প্রকারে নিরুদিদির সযত্ন সেবা উপভোগ করে নাই, সেই পাড়ারই এক প্রান্তে অন্তিমশয্যা পাতিয়া এই দুর্ভাগিনী ঘৃণায়, লজ্জায়, নিঃশব্দে নতমুখে একাকিনী দিনের পর দিন ধরিয়া এই সুদীর্ঘ ছয়মাসকাল বিনা চিকিৎসায় তাহার পদস্খলনের প্রায়শ্চিত্ত সমাধা করিয়া শ্রাবণের এক গভীর রাত্রে ইহকাল ত্যাগ করিয়া যে-লোকে চলিয়া গেলেন, তাহার অভ্রান্ত বিবরণ যে-কোনো স্মার্ত্ত ভট্টাচার্য্যকে জিজ্ঞাসা করিলেই জানা যাইতে পারিত।

 আমার পিসিমা যে অত্যন্ত সঙ্গোপনে তাহাকে সাহায্য করিতেন, এ কথা আমি এবং বাটীর বুড়া ঝি ছাড়া আর জগতে কেহই জানে না।