পাতা:শ্রীকান্ত - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শ্ৰীকান্ত করিতেন । সকলের সর্বপ্রকার রোগে, শোকে, সম্পদে, বিপদে এতবড় সেবাপরায়ণা নিঃস্বাৰ্থ পরোপকারিণী রমণী পাড়ার মধ্যে আর কেহ ছিল না। কত মেয়েকে তিনি যে লেখাপড়া শিখাইয়া, সূচের কাজ শিখাইয়া, গৃহস্থালীর সর্বপ্রকার দুরূহ কাজকর্ম শিখাইয়া দিয়া, মানুষ করিয়া দিয়াছিলেন, তাহার সংখ্যা নাই । একান্ত স্নিগ্ধ শান্তস্বভাব এবং সুনির্মল চরিত্রের জন্য পাড়ার লোকও ভঁাহাকে বড় কম ভালবাসিত না ! কিন্তু, সেই নিরুদিদির ত্ৰিশ বৎসর বয়সে হঠাৎ যখন পা-পিছলাইয়া গেল এবং ভগবান এই সুকঠিন ব্যাধির আঘাতে র্তাহার আজীবন-উচু মাথাটি একেবারে মাটির সঙ্গে একাকার করিয়া দিলেন, তখন পাড়ার কোন লোকই দুর্ভাগিনীকে তুলিয়া ধরিবার জন্য হাত বাড়াইল না। দোষস্পৰ্শলেশহীন নির্মল হিন্দুসমাজ হতভাগিনীর মুখের উপরেই তাহার সমস্ত দরজা-জানাল অ্যাটিয়া বন্ধ করিয়া দিলেন ; সুতরাং যে পাড়ার মধ্যে একটি লোকও বোধ করি ছিল না, যে কোন-না-কোন প্রকারে নিরুদিদির সযত্ন-সেবা উপভোগ করে নাই, সেই পাড়ারই একপ্ৰান্তে অন্তিম-শয্যা পাতিয়া এই দুৰ্ভাগিনী ঘূণায়, লজায়, নিঃশব্দে, নতমুখে একাকিনী দিনের পর দিন ধরিয়া এই সুদীর্ঘ ছয়মাসকাল বিনা চিকিৎসায় তাহার পদস্থলনের প্রায়শ্চিত্ত সমাধা করিয়া শ্রাবণের এক গভীর রাত্রে ইহলোক ত্যাগ করিয়া যে-লোকে চলিয়া গেলেন, তাহার অভ্ৰান্ত বিবরণ যে-কোন স্মার্ত ভট্টাচাৰ্যকে জিজ্ঞাসা করিলেই জানা যাইতে 9ifs আমার পিসিমা যে অত্যন্ত সঙ্গোপনে তঁহাকে সাহায্য করিতেন, এ-কথা আমি এবং বাটীর বুড়া বি ছাড়া আর জগতে কেহই জানে না। পিসিমা একদিন দুপুরবেলা আমাকে নিভৃতে ডাকিয়া বলিলেন, বাবা শ্ৰীকান্ত, তোরা তা এমন অনেকেরই রোগে শোকে গিয়ে দেখিস ; এই ছুড়িটাকে এক-আধবার গিয়ে দেখিস না । সেই অবধি মাঝে-মাঝে গিয়া দেখিতাম এবং পিসিমার পয়সায় এটা-ওটা-সেটা কিনিয়া দিয়া আসিতাম। তঁহার শেষকালে এক আমিই কাছে ছিলাম। মরণকালে অমন পরিপূর্ণ বিকার এবং পরিপূর্ণ জ্ঞান আমি আর দেখি নাই। বিশ্বাস না করিলেও যে ভয়ে গা ছম-হুম করে, আমি সেই কথাটাই বলিতেছি ।