পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত - উত্তরাংশ.pdf/৫৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চতুর্থ ভাগ 0 শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ১২২ রাজারামের অভিপ্রায় সিদ্ধ হইল বটে, কিন্তু তাহার ভাগ্য বিপৰ্য্যয়ের কাল উপস্থিত হইয়াছিল, তাই নবাবও তাহাকে একটা কঠিন সমস্যায় ফেলিলেন। বলা গিয়াছে যে রাজারাম পারস্য ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন, তদুল্লেখে নবাব বলিলেন—“দেওয়ানজি, পারস্য ভাষায় আপনার যেরূপ প্রগাঢ় জ্ঞান, উহা মোসলমানের পক্ষেও শোভনীয়। আমার ইচ্ছা, আমার দানের প্রতিদান স্বরূপ আপনে ইসলাম ধৰ্ম্মে দীক্ষিত হইয়া আমার কাছে অবস্থিতি করেন।” নবাবের ঈদৃশ্য বাক্য শ্রবণে রাজারাম কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইলেন, তিনি বুঝিলেন যে তত সহজে নবাবের অনুগ্রহ লাভের কারণ ইহাই। যাহাহউক, তিনি নবাবের বাক্যে অস্বীকৃত হইয়া বিপদ ঘনীভূত করিতে ইচ্ছা করিলেন না—ইসলাম-ধৰ্ম্মে দীক্ষিত হইয়া মোহাম্মদ রজা নামে সংজ্ঞিত হইলেন ও রক্ষিনগরের “চৌধুরাই” সনন্দ পাইলেন। মোসলমান ধৰ্ম্ম অবলম্বনের পর রাজারাম আর গৃহে গেলেন না, পরে এক সময় দেশে আসিয়া পুষ্করিনীর তীরে এক গৃহ নিৰ্ম্মাণ করিয়া তথায়ই অবস্থিতি করিলেন। এই সময়ে একদিন তাহার স্ত্রী সাহেবরাম ও বদলরাম নামক পুত্রদ্বয়কে লইয়া স্বামীর কাছে গিয়া পদতলে লুষ্ঠিত হইলেন। তখন স্বামী স্ত্রীকে বলিলেন—“সাধিব, তোমার পতি কর মোহাম্মদের সহিত বিবাদে নিহত হইয়াছে তুমি এখন বৈধব্যাবলম্বনে পুত্রদ্বয় সহ স্বধৰ্ম্ম পালন কর। এই অনাথ বালকদ্বয় যাহাতে কোন অসুবিধায় পতিত না হয়, আমি তাহা করিব।” “আমার স্বধৰ্ম্ম পালন ইহাই” এই বলিয়া তখন পুত্রদ্বয় সহ রাজারামপত্নী ধৰ্ম্মত্যাগী পতির পরিত্যক্ত উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করিয়া ফেলিলেন। রাজারাম তখন নিরূপায় হইয়া পুত্রদ্বয় সহ পত্নীকে ইসলাম ধৰ্ম্মে দীক্ষিত করিলে, পুত্রদ্বয় যথাক্রমে সাহেবউদ্দীন ও বদরউদ্দীন নামে সংজ্ঞিত হইলেন। ইহাদের উভয়ের নামেই রফিনগরে দুইটি দশসনা তালুক (তাং সাহেবদী ও বদরদী) আছে। রাজারাম জলডুবের রাঢ়জাতীয় শিবরামের বংশে (তদীয় দশম পুরুষে) রাজারামের উদ্ভব হয়। রাজারামের পিতার নাম সাধু। সাধুতে সাধুতা, পরদুঃখকাতরতা ও ন্যায়দর্শিতা প্রভৃতি গুণ যথেষ্ট ছিল। পিতৃগুণ পুত্রে বহুল পরিমাণে দৃষ্ট হইত,তদ্ব্যতীত রাজারামের উপাৰ্জ্জন চেষ্টা পটুতা ও পরিশ্রম-পারগতা অসাধারণ ছিল। শুধু কাযিক পরিশ্রমে ন্যায়পথে থাকিয়া রাজারামের যে অর্থ উপাজ্জিত হয়, তাহার পরিমাণ সামান্য ছিল না, একজন প্রধান ধনী বলিয়া জলডুবে রাজারামের নামডাক হইয়াছিল; এই ধন তাহার একজীবনেই অজ্জিত হয়। রাজারামের উপাজ্জিত অর্থের সদ্ব্যয়ও তৎকত্ত্বকই হইয়াছিল। তখন তৎসমাজে পূজাপাৰ্ব্বণ সদ্ব্যয়ের একমাত্র পন্থা বলিয়া পজ্ঞিাত ছিল। স্বগীয় বিষহরি পূজা, কপিলদান, ভূদান, বৃক্ষমূলে স্বগীয় কালাচাদ দেবতার আসন স্থাপন, আখড়া প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি বহুবিধ কাৰ্য্যই তাহার অপরিমিত অর্থ ব্যয়িত হয়। তদ্ব্যতীত ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবে দান, দেবসেবা, মহোৎসব, শ্ৰীক্ষেত্রাদি তীর্থদর্শন ইত্যাদি সৎকাৰ্য্যও তাহার কম ছিল না। এ সকল সৎকার্য্যের জন্য তাহার নাম তত্ৰত লোকের স্মৃতিপথারূঢ় হইয়া রহিয়াছে এবং তাহাই তাহার অধস্তন বংশীয়গণকে গৌরবান্বিত করিতেছে। পূৰ্ব্বপুরুষের অজ্জিত ধনসম্পত্তি যেমন উত্তরাধিকারসূত্রে ভোগে লাগে, পূৰ্ব্বপুরুষের কৃত সংকীৰ্ত্তিও তদ্রুপ পরবৰ্ত্তিগণের প্রভূত হিতসাধন করে। রাজারামের ছয়পুত্র, তন্মধ্যে সৰ্ব্বকনিষ্ঠ পুত্র জগন্নাথের জ্যেষ্ঠ তনয় হইতে আমরা রাজারামের কীৰ্ত্তি-কথা প্রাপ্ত হইয়াছি।