পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১২৬
সংকলন

আবার অন্তরের মধ্যে নিরস্ত হইয়া যাইতেছে। প্রত্যাখ্যান-দৃশ্যে ভয়, লজ্জা, অভিমান, অনুনয়, ভর্ৎসনা, বিলাপ, সমস্তই আছে, অথচ কত অল্পের মধ্যে। যে শকুন্তলা সুখের সময় সরল অসংশয়ে আপনাকে বিসর্জন দিয়াছিল, দুঃখের সময় দারুণ অপমানকালে সে যে আপন হৃদয়বৃত্তির অপ্রগল্‌ভ মর্যাদা এমন আশ্চর্য সংযমের সহিত রক্ষা করিবে, এ কে মনে করিয়াছিল। এই প্রত্যাখ্যানের পরবর্তী নীরৱতা কী ব্যাপক, কী গভীর। কণ্ব নীরব, অনসূয়া-প্রিয়ংবদা নীরব, মালিনীতীর-তপোবন নীরব। সর্বাপেক্ষা নীরব শকুন্তলা। হৃদয়বৃত্তিকে আলোড়ন করিয়া তুলিবার এমন অবসর কি আর কোনো নাটকে এমন নিঃশব্দে উপেক্ষিত হইয়াছে। দুষ্যন্তের অপরাধকে দুর্বাসার শাপের আচ্ছাদনে আবৃত করিয়া রাখা, সেও কবির সংযম। দুষ্ট প্রবৃত্তির দুরন্তপনাকে অবারিতভাবে উচ্ছৃঙ্খলভাবে দেখাইবার যে-প্রলোভন, তাহাও কবি সংবরণ করিয়াছেন। তাঁহার কাব্যলক্ষ্মী তাঁহাকে নিষেধ করিয়া বলিয়াছেন:

ন খলু ন খলু বাণঃ সন্নিপাত্যোঽয়মস্মিন্
মৃদুনি মৃগশরীরে পুষ্পরাশিবিবাগ্নিঃ।

 দুষ্যন্ত যখন কাব্যের মধ্যে বিপুল বিক্ষোভের কারণ লইয়া মত্ত হইয়া প্রবেশ করিলেন, তখন কবির অন্তরের মধ্যে এই ধ্বনি উঠিল:

মূর্তো বিঘ্নস্তপস ইব নো ভিন্নসারঙ্গযুগো
ধর্মারণ্যং প্রবিশতি গজঃ স্যন্দনালোকভীতঃ।

তপস্যার মূর্তিমান বিঘ্নের ন্যায় গজরাজ ধর্মারণ্যে প্রবেশ করিয়াছে। এইবার বুঝি কাব্যের শান্তিভঙ্গ হয়— কালিদাস তখনি ধর্মারণ্যের, কাব্যকাননের এই মূর্তিমান বিঘ্নকে শাপের বন্ধনে সংযত করিলেন; ইহাকে দিয়া তাঁহার পদ্মবনের পঙ্ক আলোড়িত করিয়া তুলিতে দিলেন না।