পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
নববর্ষা
২২১

 বিরহীর ব্যগ্রতাতেও কবি পথসংক্ষেপ করেন নাই। আষাঢ়ের নীলাভ মেঘচ্ছায়াবৃত নগ নদী নগর জনপদের উপর দিয়া রহিয়া রহিয়া ভাবাবিষ্ট অলসগমনে যাত্রা করিয়াছেন। যে তাঁহার মুগ্ধনয়নকে অভ্যর্থনা করিয়া ডাকিয়াছে, তিনি তাহাকে আর ‘না’ বলিতে পারেন নাই। পাঠকের চিত্তকে কবি বিরহের বেগে বাহির করিয়াছেন, আবার পথের সৌন্দর্যে মন্থর করিয়া তুলিয়াছেন। যে চরম স্থানে মন ধাবিত হইতেছে, তাহার সুদীর্ঘ পথটিও মনোহর, সে-পথকে উপেক্ষা করা যায় না।

 বর্ষায় অভ্যস্ত পরিচিত সংস্কার হইতে বিক্ষিপ্ত হইয়া মন বাহিরের দিকে যাইতে চায়, পূর্বমেঘে কবি আমাদের সেই আকাঙ্ক্ষাকে উদ্‌বেলিত করিয়া তাহারই কলগান জাগাইয়াছেন; আমাদিগকে মেঘের সঙ্গী করিয়া অপরিচিত পৃথিবীর মাঝখান দিয়া লইয়া চলিয়াছেন। সে পৃথিবী ‘অনাঘ্রাতং পুষ্পম্’, তাহা আমাদের প্রাত্যহিক ভোগের দ্বারা কিছুমাত্র মলিন হয় নাই, সে-পৃথিবীতে আমাদের পরিচয়ের প্রাচীর দ্বারা কল্পনা কোনোখানে বাধা পায় না। যেমন ঐ মেঘ তেমনি সেই পৃথিবী। আমার এই সুখদুঃখক্লান্তি-অবসাদের জীবন তাহাকে কোথাও স্পর্শ করে নাই। প্রৌঢ়বয়সের নিশ্চয়তা বেড়া দিয়া ঘের দিয়া তাহাকে নিজের বাস্তবাগানের অন্তর্‌ভুক্ত করিয়া লয় নাই।

 অজ্ঞাত নিখিলের সহিত নবীন পরিচয়, এই হইল পূর্বমেঘ। নবমেঘের আর-একটি কাজ আছে। সে আমাদের চারিদিকে একটি পরমনিভৃত পরিবেষ্টন রচনা করিয়া, ‘জননান্তরসৌহৃদানি’ মনে করাইয়া দেয়; অপরূপ সৌন্দর্যলোকের মধ্যে কোনো একটি চিরজ্ঞাত চিরপ্রিয়ের জন্য মনকে উতলা করিয়া তোলে।

 পূর্বমেঘে বহুবিচিত্রের সহিত সৌন্দর্যের পরিচয় এবং উত্তরমেঘে সেই একের সহিত আনন্দের সম্মিলন। পৃথিবীতে বহুর মধ্য দিয়া সেই সুখের যাত্রা, এবং স্বর্গলোকে একের মধ্যে সেই অভিসারের পরিণাম।