পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দুঃখ
২৫৭

আমাদের দৃষ্টিকে সার্থক করিতেছে না, তাহা আমাদের অন্তঃকরণকে উদ্‌বোধিত করিয়া তুলিতেছে এবং যাহা-কিছু আছে তাহা কেবল আছে মাত্র নহে, তাহাতে আমাদের চিত্তকে চেতনায়, আমাদের আত্মাকে সত্যে সম্পূর্ণ করিতেছে।

 যখন দেখি শীতকালের পদ্মার নিস্তরঙ্গ নীলকান্ত জনস্রোত পীতাভ বালুতটের নিঃশব্দ নির্জনতার মধ্য দিয়া নিরুদ্দেশ হইয়া যাইতেছে, তখন ‘নদীর জল বহিতেছে’ এই বলিলেই তো সব বলা হইল না— এমন কি, কিছুই বলা হইল না। তাহার আশ্চর্য শক্তি ও আশ্চর্য সৌন্দর্যের কী বলা হইল। সেই বচনের অতীত পরম পদার্থকে, সেই অপরূপ রূপকে, সেই ধ্বনিহীন সংগীতকে, এই জলের ধারা কেমন করিয়া এত গভীরভাবে ব্যক্ত করিতেছে। এ তো কেবলমাত্র জল ও মাটি—মৃৎপিণ্ডো জলরেখয়া বলয়িতঃ। কিন্তু যাহা প্রকাশ হইয়া উঠিতেছে তাহা কী। তাহাই আনন্দরূপমমৃতম্, তাহাই আনন্দের অমৃতরূপ।

 আবার কালবৈশাখীর প্রচণ্ড ঝড়েও এই নদীকে দেখিয়াছি। বালি উড়িয়া সূর্যাস্তের রক্তচ্ছটাকে পাণ্ডুবর্ণ করিয়া তুলিয়াছে, কশাহত কালো ঘোড়ার মসৃণ চর্মের মতো নদীর জল রহিয়া রহিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে, পরপারের স্তব্ধ তরুশ্রেণীর উপরকার আকাশে একটা নিঃস্পন্দ আতঙ্কের বিবর্ণতা ফুটিয়া উঠিয়াছে; তারপর সেই জল-স্থল-আকাশের জালের মাঝখানে নিজের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মেঘমধ্যে জড়িত আবর্তিত হইয়া উন্মত্ত ঝড় একেবারে দিশাহারা হইয়া আসিয়া পড়িল— সেই আবির্ভাব দেখিয়াছি। তাহা কি কেবল মেঘ এবং বাতাস, ধুলা এবং বালি, জল এবং ডাঙা। এই সমস্ত অকিঞ্চিৎকরের মধ্যে এ যে অপরূপের দর্শন। ইহা তো শুধু বীণার কাঠ ও তার নহে, ইহাই বীণার সংগীত। এই সংগীতেই আনন্দের পরিচয়, সেই আনন্দরূপমমৃতম্।

 আবার মানুষের মধ্যে যাহা দেখিয়াছি তাহা মানুষকে কতদূরেই