পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

মানুষের মনকে বলে, ‘আনন্দের ক্ষেত্রে তোমাকে আহ্বান ক’রে আনব ব’লে আমি তোমার জন্যেই সেজেছি।’ মধুকর ফুলের কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস ক’রে কিছুমাত্র ঠকে নি; আর মানুষের মনও যখন বিশ্বাস ক’রে তাকে ধরা দেয় তখন দেখতে পায়, ফুল তাকে মিথ্যা বলে নি।

 ফুল যে কেবল বনের মধ্যেই কাজ করছে তা নয়, মানুষের মনের মধ্যেও তার যেটুকু কাজ তা সে বরাবর করে আসছে।

 আমাদের কাছে তার কাজটা কী। প্রকৃতির দরজায় যে-ফুলকে যথা-ঋতুতে যথাসময়ে মজুরের মতো হাজরি দিতে হয়, আমাদের হৃদয়ের দ্বারে সে রাজদূতের মতো উপস্থিত হয়ে থাকে।

 সীতা যখন রাবণের ঘরে একা বসে কাঁদছিলেন তখন একদিন যে দূত তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হয়েছিল, সে রামচন্দ্রের আংটি সঙ্গে করে এনেছিল। এই আংটি দেখেই সীতা তখনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই দূতই তাঁর প্রিয়তমের কাছ থেকে এসেছে; তখনই তিনি বুঝলেন, রামচন্দ্র তাঁকে ভোলেননি, তাঁকে উদ্ধার করে নেবেন বলেই তাঁর কাছে এসেছেন।

 ফুলও আমাদের কাছে সেই প্রিয়তমের দূত হয়ে আসে। সংসারের সোনার লঙ্কায় রাজভোগের মধ্যে আমরা নির্বাসিত হয়ে আছি, আমাদের কেবলই বলছে, ‘আমিই তোমার পতি, আমাকেই ভজনা করো।’

 কিন্তু সংসারের পারের খবর নিয়ে আসে ঐ ফুল। সে চুপিচুপি আমাদের কানে এসে বলে, ‘আমি এসেছি, আমাকে তিনি পাঠিয়েছেন। আমি সেই সুন্দরের দূত, আমি সেই আনন্দময়ের খবর নিয়ে এসেছি। এই বিচ্ছিন্নতার দ্বীপের সঙ্গে তাঁর সেতু বাঁধা হয়ে গেছে, তিনি তোমাকে এক মুহূর্তের জন্যে ভোলেন নি, তিনি তোমাকে উদ্ধার করবেন। তিনি তোমাকে টেনে নিয়ে আপন করে নেবেন। মোহ তোমাকে এমন করে চিরদিন বেঁধে রাখতে পারবে না।