পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৯৬
সংকলন

পৃথিবী

 কালীগ্রাম, জানুয়ারি ১৮৯১। ঐ-যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে, ওটাকে এমন ভালোবাসি! ওর এই গাছপালা, নদী মাঠ, কোলাহল নিস্তব্ধতা, প্রভাত সন্ধ্যা, সমস্তটা-সুদ্ধ দু হাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে হয়, পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি, এমন কি কোনো স্বর্গ থেকে পেতুম। স্বর্গ আর কী দিত জানি নে, কিন্তু এমন কোমলতা-দুর্বলতা-ময় এমন সকরুণ-আশঙ্কা-ভরা অপরিণত এই মানুষগুলির মতো এমন আপনার ধন কোথা থেকে দিত। আমাদের এই মাটির মা, আমাদের এই আপনাদের পৃথিবী এর সোনার শ্যক্ষেত্রে, এর স্নেহশালিনী নদীগুলির ধারে, এর সুখদুঃখময় ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে, এই সমস্ত দরিদ্র মর্ত্যহৃদয়ের অশ্রুর ধনগুলিকে কোলে করে এনে দিয়েছে। আমরা হতভাগ্যরা তাদের রাখতে পারি নে, বাঁচাতে পারি নে, নানা অদৃশ্য প্রবল শক্তি এসে বুকের কাছ থেকে তাদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায়, কিন্তু বেচারা পৃথিবীর যতদূর সাধ্য সে করেছে। আমি এই পৃথিবীকে ভারি ভালোবাসি। এর মুখে ভারি একটি সুদরব্যাপী বিষাদ লেগে আছে; যেন এর মনে মনে আছে, “আমি দেবতার মেয়ে, কিন্তু দেবতার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ভালোবাসি, কিন্তু বক্ষা করতে পারি নে; আরম্ভ করি, সম্পূর্ণ করতে পারি নে; জন্ম দিই, মৃত্যুব হাত থেকে বাঁচাতে পারি নে।” এইজন্যে স্বর্গের উপব আড়ি ক’রে আমি আমার দরিদ্র মায়ের ঘর আরো বেশি ভালোবাসি; এত অসহায়, অসমর্থ, অসম্পূর্ণ, ভালোবাসার সহস্র আশঙ্কায় সর্বদা চিত্তাকাতর ব’লেই।