পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শিক্ষার মিলন
৩৭

এইখানেই তার লড়াই। যেখানে তার অমৃত, যেখানে মানুষ—বস্তুকে নয়— আত্মাকে প্রকাশ করে, সেখানে সকলকে সে ডেকে আনে, সেখানে ভাগের দ্বারা ভোজের ক্ষয় হয় না; সুতরাং সেইখানেই শান্তি।

 নিয়মকে কাজে খাটিয়ে আমরা ফল পাই, কিন্তু ফল পাওয়ার চেয়েও মানুষের একটা বড়ো লাভ আছে। চা-বাগানের ম্যানেজার কুলিদের ’পরে যে-নিয়ম চালনা করে, সে-নিয়ম যদি পাকা হয় তাহলে চায়ের ফলনের পক্ষে কাজে লাগে। কিন্তু, বন্ধু সম্বন্ধে ম্যানেজারের তো পাকা নিয়ম নেই। তার বেলায় নিয়মের কথাই ওঠে না। ঐ জায়গাটাতে চায়ের আয় নেই, ব্যয় আছে। কুলির নিয়মটা আধিভৌতিক বিশ্বনিয়মের দলে, সেইজন্যে সেটা চা-বাগানেও খাটে। কিন্তু, যদি এমন ধারণা হয় যে, ঐ বন্ধুতার সত্য কোনো বিরাট সত্যের অঙ্গ নয়, তাহলে সেই ধারণায় মানবত্বকে শুকিয়ে ফেলে। কলকে তো আমরা আত্মীয় ব’লে বরণ করতে পারি নে; তাহলে কলের বাইরে কিছু যদি না থাকে তবে আমাদের যে আত্মা আত্মীয়কে খোঁজে সে দাঁড়ায় কোথায়।

 যান্ত্রিকতাকে অন্তরে বাহিরে বড়ো ক’রে তোলার পশ্চিমসমাজে মানব-সম্বন্ধের বিশ্লিষ্টতা ঘটেছে। কেননা, স্ক্রু-দিয়ে আঁটা, আঠা দিয়ে জোড়ার বন্ধনকেই ভাবনায় এবং চেষ্টায় প্রধান করে তুললে, অন্তরতম যে আত্মিক বন্ধনে মানুষ স্বতঃপ্রসাধিত আকর্ষণে পরস্পর গভীরভাবে মিলে যায়, সেই সৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন বন্ধন শিথিল হতে থাকে। অথচ, মানুষকে কলের নিয়মে বাঁধার আশ্চর্য সফলতা আছে; তাতে পণ্যদ্রব্য রাশীকৃত হয়, বিশ্ব জুড়ে হাট বসে, মেঘ ভেদ করে কোঠাবাড়ি ওঠে।

 কেননা, পূর্বেই বলেছি, বিশ্বের বাহিরের দিকে এই কল জিনিসটা সত্য। সেইজন্যে এই যান্ত্রিকতায় যাদের মন পেকে যায় তারা যতই ফললাভ করে ফললাভের দিকে তাদের লোভের ততই অন্ত থাকে না।