পাতা:সংস্কৃতি কথা - মোতাহের হোসেন চৌধুরী.pdf/১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা

উজ্জ্বল নক্ষত্রটি এক স্নিগ্ধ আলো বিকীরণ করছিলেন দীর্ঘকাল ধরে। যাঁরা তাঁকে জানতেন, যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁরা এই আলোর সন্ধান রাখতেন এবং এর মূল্য তাঁরা ভালোভাবেই বুঝতেন। তিনি ছিলেন অনেকখানি কস্তুরী-মৃগের মতো, আপনার সৌরভে আপনি ছিলেন মুগ্ধ। তাই প্রচারের মোহ তাঁর মধ্যে কোনোদিন দেখা যায়নি। এই সৌরভের স্বাদও একমাত্র আত্মীয় বান্ধব ও অন্তরঙ্গজনেরাই পেতেন। আজকের দিনে মন ও চরিত্রের এই সৌরভ ও মাধুর্য যে কত দুর্লভ, তা বলাই বাহুল্য। ইংরেজিতে যাকে ‘লিবারেল’ বলে, তিনি ছিলেন তাই। রাজনীতি ক্ষেত্রে যেমন আজ লিবারেলের কোনো স্থান নেই, তেমনি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও আজ লিবারেলরা হতশক্তি ও হতমান। নিজের চোখের সামনে মোতাহের হোসেন এই ওলট-পালট, সাহিত্য-শিল্পের মূল্য বিচারের মানদণ্ডে এই দ্রুত ওঠা-নামা দেখেছেন। কিন্তু সত্যিকার লিবারেলের মতো তিনি এক দিনের তরেও একে ধিক্কার দেননি, হননি এর প্রতি অসহিষ্ণু অথচ মুহূর্তের জন্যও নিজে যুক্তিবাদী লিবারেল জীবনদর্শন ত্যাগ করেননি আশু জনপ্রিয়তা বা হাততালির মোহে। রবীন্দ্রনাথ-প্রমথ চৌধুরীর রচনার শিল্প-সৌন্দর্য ও মানসপ্রসার, কাজী আবদুল ওদুদের যুক্তিবাদ, বার্ট্রাণ্ড রাসেল, ক্লাইভ বেল প্রমুখ ইংরেজ লেখকদের সংস্কৃতিবোধ ও মানবিকতার তিনি অনুরক্ত, ভক্ত ও রসগ্রাহী ছিলেন। এঁদের রচনা তাঁর বিশেষ প্রিয় ও উপভোগের বস্তু ছিলো। এঁদের রচনার উদার পরিবেশেই তাঁর মন ও চরিত্র গ’ড়ে উঠেছিল বল্লে অত্যুক্তি করা হবে না। তাঁর নিজের রচনাও এই পরিবেশেরই সাক্ষাৎ ফল।

 আমরা যারা শিক্ষকতা করি, তাদের পক্ষে মনমেজাজ শান্ত ও সুস্থ রাখা একরকম অসম্ভব বল্লেই চলে। রোজ এত বিচিত্র মানবের সঙ্গে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়, মোকাবেলা করতে হয় মানব চরিত্রের হরেক রকম বিরুদ্ধতা ও জটিলতার সঙ্গে। তদুপরি দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠানগত অব্যবস্থার জন্য শিক্ষক ছাত্রের সম্পর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে একরকম শাসক-শাসিতের সম্পর্কের মতো। এই অবস্থা ও পরিবেশে কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের মন-মেজাজ তিরিক্ষে ক’রে ছাড়ে। ক্রমে ক্রমে এই তিরিক্ষে মেজাজ অনেকের প্রায় স্বভাবগত হয়ে পড়ে। আশ্চর্য, কি এক অদ্ভুত ক্ষমতা বলে মোতাহের হোসেন এই অনিবার্য পরিণাম থেকে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর কথা ও ব্যবহারে রুক্ষতা ও কঠোরতা ছিল না, তাঁকে কোনোদিন ধৈর্য হারাতে দেখা যায়নি। তাঁর স্বভাব ও ব্যবহারের বিনম্র মাধুর্য ও আলাপ-আলোচনায় সরস পরিহাস-প্রিয়তা শেষদিন পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। ছাত্রদের সঙ্গেও এই ব্যবহারের ব্যতিক্রম ঘটেনি কোনোদিন। এই স্বভাব-মাধুর্যের ফলে তিনি হতে পেরেছিলেন অজাত-শত্রু। আজকের দিনে এ-ও এক অসাধ্য সাধন ও নেহাৎ ভাগ্যের কথা। আমার বিশ্বাস, যে-লিবারেল ভাবধারার তিনি উত্তরাধিকারী, নিষ্ঠাবান অনুসরণকারী এবং পরিশীলনকারী ছিলেন এ-ও তারই প্রতিদান।

 মোতাহের হোসেন সুপুরুষ ছিলেন। তাঁর বৃহৎ আয়ত চক্ষু দু’টির প্রসন্ন উজ্জ্বলতা আকর্ষণীয় ছিল। তাঁর স্বভাব ও চরিত্রের অকৃপণ মাধুর্য তাঁর চেহারা ও চোখ দু’টিতে প্রতিফলিত হ’ত। এ কারণে তাঁকে একবার দেখলেও ভুলে যাওয়া সম্ভব ছিল না। Liberalism-এর চর্চা ও তার ভাবাদর্শ তাঁর জীবনকে সুসংহত, মধুর ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে, পরিমিত পরিধিতে আমাদের এ যুগের সাহিত্যিকদের মধ্যে একমাত্র মোতাহের হোসেনই ছিলেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ...তাঁকে যতো নিকট থেকে দেখা যেতো এবং যতো ঘনিষ্ঠভাবে তাঁর সঙ্গে মেলামেশা ঘটতো ততোই তাঁর মনের প্রসার, চরিত্রের অসাধারণত্ব ও অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য বেশি করে ফুটে উঠতো।...’

[মাহেনও, অগ্রহায়ণ ১৩৬৩]