পাতা:সংস্কৃতি কথা - মোতাহের হোসেন চৌধুরী.pdf/২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সংস্কৃত-কথা
১৯

করা, এ-ই কাল্‌চার্ড জীবনের উদ্দেশ্য। এই কথা যখন অন্তরে জাগে তখন বাইরেও তার প্রভাব উপলব্ধ হয়। তখন স্বতঃই বলতে ইচ্ছে হয়:

স্বর্গ আমার জন্ম নিল মাটির মায়ের কোলে
বাতাসে সেই খবর ছোটে আনন্দ কল্লোলে।

 ধর্ম চায় মানুষকে পাপ থেকে, পতন থেকে রক্ষা করতে, মানুষকে বিকশিত করতে নয়। জীবনের গোলাপ ফোটানোর দিকে তার নজর নেই, চক্ষুটিকে নিষ্কণ্টক রাখাই তার উদ্দেশ্য। অপর পক্ষে কাল্‌চারের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনের বিকাশ, পতন পাপ থেকে রক্ষা নয়। গোলাপের সঙ্গে যদি দু’একটা কাঁটা এসেই যায় তো আসুক না, তাতে ক্ষতি নেই, দেখতে হবে শুধু ফুল ফুটল কি-না-এ-ই কাল্‌চারের অভিমত। মনুষ্যত্বের বিকাশই সব চেয়ে বড় কথা, চলার পথে যে স্খলন-পতন তা থেকে রক্ষা পাওয়াটাই বড় কথা নয়। বরং বড় জীবনের তাগিদে এলে এই স্খলন-পতন ও মর্যাদাও বেড়ে যায় অনেকখানি। মর্যাদাবান হয়ে ওঠে।

 বিকাশকে বড় করে দেখে না বলে ধর্ম সাধারণতঃ ইন্দ্রিয়সাধনার পরিপন্থী। অথচ ইন্দ্রিয়ের পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে জীবনসাধনারই অপর নাম কাল্‌চার। মন ও আত্মার সঙ্গে যোগযুক্ত করে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বকের নবজন্মদানই কালচারের উদ্দেশ্য। অবশ্য এই ইন্দ্রিয়নিচয়ের সবকটিই যে সমমূল্য তা নয়। ইন্দ্রিয়গুলির মধ্যে চক্ষু আর কানই সেরা। তাই তাদের স্থান সকলের আগে দেওয়া হয়েছে। চোখের মানে ছবির সাধনা, কানের সাধনা গানের। (সাহিত্যের মধ্যে চোখ ও কান উভয়েরই কাজ রয়েছে, কেননা তা ছন্দ ও ছবি উভয়ের মিলন।) চোখ ও কানের পরেই নাসিকার স্থান-নিঃশ্বাস গ্রহণের সহায়তায় বাঁচবার সুযোগ দেয় বলে নয়, সুগন্ধ উপলব্ধির দ্বারা আত্মাকে প্রফুল্ল রাখবার সুযোগ দেয় বলে। চোখ ও কান ‘আত্মার’ জিহ্বা, এদের মারফতেই সে তার খাদ্য চয়ন করে। অথচ, ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, কোনো কোনো ধর্ম এই চোখ ও কানের সাধনারই পরিপন্থী, সেখানে তারা পতনের ফাঁদ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। তাই আমরা চোখ থাকতেও কানা, কান থাকতেও কালা। সুর বা ছবির সূক্ষ্মতা আমাদের প্রাণে দাগ কাটে না। চোখ ও কানের প্রতি বেখেয়াল থাকা যে আত্মার প্রতিই বেখেয়াল থাকা, সংস্কৃতিবানরা তা বুঝলেও ধার্মিকের মাথায় তা সহজে ঢোকে না। তাই তারা শুধু ঈশ্বরের নাম নেয়, ঐশ্বর্য উপলব্ধি করে না।[১]

 ইন্দ্রিয়ের সাধনা বলে কাল্‌চারের কেন্দ্র নারী। নারীর চোখ-মুখ, স্নেহ-প্রীতি, শ্রী ও হ্রী নিয়েই কাল্‌চারের বাহন শিল্প-সাহিত্যের কারবার। ইন্দ্রিয়গ্রামের জাগরণ ও নিয়ন্ত্রণের মূলেও নারী। ‘বোধকলি’ তার প্রসাদেই ফোটে, জীবনের শক্তি, সাহস ও সাধনার প্রেরণা নারী থেকেই আসে। তাই কবির মুখে শুনতে পাওয়া যায়: ‘আমি হব না তাপস, হব না, যদি না পাই গো তপস্বিনী।’ জীবনে তপস্যা করতে চায় বলে নারীসঙ্গ কাল্‌চার্ড মানুষের এতো কাম্য। বৈরাগীরা নারীকে পর করে সংস্কৃতিকেও পর করে। তাই তাদের জীবনে ঋদ্ধি নেই, তারা নিঃস্ব-নব নব বুদ্ধি ও প্রীতির স্বাদ থেকে


  1. ঈশ্বরকে চাওয়া মানে ঐশ্বর্যকে চাওয়া। রামকৃষ্ণ বলতেন: ঈশ্বর বেটাকে কে মানতো যদি তার ঐশ্বর্য না থাকতো? এই উক্তির তাৎপর্য উপলব্ধি-যোগ্য। বিভিন্ন ধর্মের আশ্রয়ে তাঁর যে সাধনা তা চিত্ত সমৃদ্ধিরই সাধনা। পথের বৈচিত্র্যের স্বাদ তিনি পেতে চেয়েছিলেন নইলে পথ যে আসলে এক, তা কি তিনি জানতেন না?