পাতা:সংস্কৃতি কথা - মোতাহের হোসেন চৌধুরী.pdf/২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২০
সংস্কৃতি-কথা

বঞ্চিত। কী মানসিক, কী সাংসারিক সর্বপ্রকার সমৃদ্ধির গোড়ায় নারী। যাত্রাপথে নারীর জয়ধ্বনিই পুরুষের জীবন-পথের শ্রেষ্ঠ পাথেয়। যে জাতি নারীকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা রাখতে চায় সে-জাতি জীবনে মৃত্যুর আরাধনা করে-ইতিহাসের খাতায় সে মরা-জাতির পৃষ্ঠায় নাম লেখায়। তার জীবনে আত্ম-নির্যাতন আছে, আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই। আর আত্মনিয়ন্ত্রণ নেই বলে সংস্কৃতিও নেই। কেননা সংস্কৃতি মানেই আত্মনিয়ন্ত্রণ-নিজের আইনে নিজেকে বাঁধা।

 ধর্মের মধ্যে বৈরাগ্যের বীজ উপ্ত রয়েছে। কোনো কোনো ধর্ম নারীকে দেখেছে বিষের নজরে, আর কোনো কোনো ধর্ম ততটা না গেলেও সঙ্গীত-নৃত্যের মারফতে নারীকে ঘিরে যে ইন্দ্রজাল সৃষ্টি তাতে জানিয়েছে ঘোর আপত্তি। সঙ্গীত-নৃত্য ইত্যাদি তার কাছে কামেরই আয়োজন, কামের উন্নয়ন নয়। ফলে সূক্ষ্ম উপভোগের সহায় না হয়ে নারী স্থুল ভোগের বস্তু হয়েই রইল, নব নব উন্মেষশালিনী বুদ্ধির প্রেরক ও উচ্চতর জীবনের সহায় হতে আর পারলে না। যৌন ব্যাপারে বিশেষ ও কড়া শাসনের ফলে মানুষ তাতেই আকৃষ্ট হয়ে রইল—যৌন সম্ভোগকে অতিক্রম করে যে প্রেম ও আনন্দ তা অনুভব করতে পারলে না বলে। নিষিদ্ধ বস্তু সাধারণতঃ ভীতি ও অতিরিক্ত আকর্ষণ— এই দুই মনোবৃত্তির সংঘর্ষ বাধিয়ে জীবনে বিকৃতি ঘটায়। এখানেও তাই হল, যৌন ব্যাপার মন্দ, এ কথা না বলে যদি বলা হ’ত: প্রেম ভালো, আনন্দ ভালো, প্রেমের জন্য প্রতীক্ষা ভালো, আনন্দের জন্য প্রতীক্ষা ভালো, তা হলে পৃথিবীর চেহারা হয়তো এতো কদর্য হত না। প্রেমের দ্বারা কাম নিয়ন্ত্রিত হ’ত বলে ব্যভিচার ও নিরোধ উভয়ের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ সহজ ও সুন্দর হতে পারত।

 কিন্তু তা না বলে নীতিবিদরা মানুষকে সংযম শিক্ষা করতে বললেন, অথচ কোন্ বড় জিনিসের দিকে তাকিয়ে তা করতে হবে তা বালালেন না। কেবল স্বর্গের দিকে ইঙ্গিত করলেন। আর স্বর্গের যে চিত্রটি আঁকা হল তাতে এখানে যা ভয়ঙ্কর বলে সাব্যস্ত, সেই ইন্দ্রিয়বিলাসেরই জয় জয়কার ঘোষিত হল। তাই ইন্দ্রিয়-ভীতি সত্ত্বেও মানুষ ইন্দ্রিয় সর্বস্বতার দিকে ঝুঁকলে—মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলবার মতো বড় কিছুর আশ্রয় খুঁজে পেলে না। নীতিবিদদের জানা উচিত ছিল, সংযম বলে কোনো স্বাস্থ্য-প্রদায়ী বস্তু নেই, আছে বড় জিনিসের জন্য প্রতীক্ষা আর সেই বড় জিনিস হচ্ছে প্রেম। যে প্রেমে পড়েছে, অথবা প্রেমের মূল্য উপলব্ধি করেছে সে-ই প্রতীক্ষা করতে শিখেছে, অর্থাৎ সে-ই সহজে সংযমী হতে শিখেছে, অপরের পক্ষে সংযম মানে পীড়ন আর পীড়ন নিষ্ঠুরতার জনয়িত্রী। যে বিনা কারণে নিজেকে দুঃখ দেয়, অপরকে দুঃখ দিতে তার তিলমাত্রও বাধে না। Sadism-এর গোড়ায় আত্মপীড়ন, এ কথা মনে রাখা চাই।

 নিষ্ঠুরতা থেকে মুক্তি পাওয়ার অন্যতম উপায় যৌনতৃপ্তি। যৌনতৃপ্তির উপায় কামকে প্রেমের সঙ্গে যুক্ত করা। শুধু কামে তৃপ্তি নেই, তা পরিণামে ক্লান্তি ও অবসাদ নিয়ে আসে। প্রেমের সঙ্গে যুক্ত হয়েই কাম স্নিগ্ধ ও তৃপ্তিকর হয়ে ওঠে। অথচ সমাজ বিয়ের মারফতে কামের দ্বারটি খোলা রাখলেও (বিয়ে মানে: Sex made-easy), প্রেমের দ্বারটি বন্ধ করে দিয়েছে।

 বিবাহিত নর-নারীর প্রেমহীন স্থুল যৌনসম্ভোগে সমাজের আপত্তি নেই, কিন্তু অবিবাহিত প্রেমিক-প্রেমিকা যদি একটু হাতে হাত রাখে, অথবা ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকায় তবেই যতো আপত্তি। প্রীতিকে বড় করে না দেখে নীতিকে বড় করে দেখার এ-ই স্থুল পরিণতি। বলা হবে সমাজকে রক্ষা করতে হলে এই স্থূলতার প্রয়োজন আছে, অতএব