পাতা:সংস্কৃতি কথা - মোতাহের হোসেন চৌধুরী.pdf/২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সংস্কৃতি-কথা
২১

তা দোষাবহ নয়। উত্তরে বলব: হাঁ, সমাজের কাজ তো ঐ পর্যন্তই, নিজের কাঠামোটুকু টিকিয়ে রাখাই তার কাজ, তার বেশী কিছু নয়। ব্যক্তির বিকাশের কথা সে যতটুকু ভাবে, তার চেয়ে অনেক বেশী ভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখার কথা, আর সমাজকে টিকিয়ে রাখা মানে সমাজের মোড়লদের টিকিয়ে রাখা-তাদের স্বার্থকে অক্ষত রাখা। মানুষ গোল্লায় যাক, তবু মোড়লদের জবরদস্তি বজায় থাক, এই-তো সমাজের কাম্য। সমাজ মানুষের বৃদ্ধি চায় না, চায় একটা ছাঁচের মধ্যে ফেলে তাকে কোনোপ্রকারে টিকিয়ে রাখতে-তার চূড়ান্ত বৃদ্ধিতে বাধা দিতে।

 তাই ব্যক্তির আত্মপ্রকাশের ভার নিয়েছে কাল্‌চার। যৌনব্যভিচারের দ্বারা লোকটি নিজেকে ও সমাজকে গোল্লায় পাঠাচ্ছে কিনা সেদিকে তার নজর নেই। শকুনের মতো সে মরা গরুর সন্ধানে থাকে না, বুলবুলের মতো তার দৃষ্টি থাকে গোলাপ-কুঞ্জের দিকে। লোকটির মনে সৌন্দর্য ও প্রেমের পরিচয় পাওয়া যায় কি-না, তার বুকে মানুষ ও মনুষ্যত্বের জন্য সজীব দরদ আছে কি-না, নিষ্ঠুরতাকে সে মনে-প্রাণে ঘৃণা করে কি-না, তা-ই সে দেখতে চায়, এবং দেখতে পেলে খুশী হয়ে সাত খুন মাফ করে দেয়। কেননা, সে জানে প্রেম ও সৌন্দর্যের পূজারীদের জীবনে এখানে-সেখানে স্খলন-পতন থাকলেও, যাকে বলা হয় ব্যভিচার তা কখনো থাকতে পারে না। লোভ ও লালসার হাতে ক্রীড়নক হতে চায় না বলে তারা সদা পবিত্র-গঙ্গাধারার মতো কখনো কখনো পঙ্কিলতা বহন করেও অপঙ্কিল। কিন্তু পঙ্কিলতাঅপঙ্কিলতার প্রতি ধার্মিকের দৃষ্টি নেই। তার দৃষ্টি কেবল নীতিরক্ষার দিকে। নীতিরক্ষা হলেই ব্যস, লেফাফাদুরস্তি ও লেবাস-পোরস্তিই তার কাছে জীবনের প্রথম ও শেষ কথা। আত্মার দিকে তার নজর নেই, নীতিরক্ষী নির্দয় ও নিষ্প্রাণ মানুষকেও সে শ্রদ্ধা জানায়।

 কামকে দমাতে গিয়ে ধর্ম ও ধর্ম-সৃষ্ট সমাজ প্রেমকেই দমায়। প্রেম মরে যায়, কাম গোপনতার আশ্রয় গ্রহণ করে টিকে থাকে-মুখ নীচু ক'রে চোরের মতো চলে। সমাজ তাতেই খুশী। কেননা, সে ভীরুতাই পছন্দ করে, সাহস নয়। প্রেম অন্যায়কারী বলে নয়, সাহসী বলেই সমাজের যত ক্রোধ তার উপরে গিয়ে পড়ে। প্রেমিকের আচরণে একটা চ্যালেঞ্জ দেখতে পায় বলে সে তাকে সহ্য করতে পারে না। (সমাজ যেন নীরব ভাষায় বলে ডুবে-ডুবে জল খা’না-কে তাতে আপত্তি করে? অত দেখিয়ে দেখিয়ে খাচ্ছিস যে, সাহসের বাড় বেড়েছে বুঝি? আচ্ছা দাঁড়া তোর বড়াই ভাঙছি।) গোপনে পাপ করে চলো কেউ কিছু বলবে না; না জানলে তো নয়ই, জানলেও না। তুমি যে মাথা হেঁট করে চলেছ তাতেই সকলে খুশী, তোমাকে অবনতশিরই তারা দেখতে চায়। প্রেমের শির উন্নত বলেই তার বিপদ-সমাজের যত বজ্রবাণ তার মাথার উপরেই বর্ষিত হয়।

 নীতির ব্যর্থতার যে এই একটি দিকই তা নয়, অন্য দিকও আছে। একটি ব্যাপারে কেন্দ্রীভূত হওয়ার দরুণ জীবনের সর্বত্র তার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে না। যৌনব্যভিচারী যেমন সমাজের চক্ষুশূল, উৎকোচগ্রহণকারী বা ব্লাকমার্কেটিয়ার তেমনটি নয়। অথচ যৌনব্যভিচারের চেয়ে উৎকোচ গ্রহণ আর কালোবাজারি যে সমাজের পক্ষে কম অকল্যাণকর তা কেউ বলবে না। নীতির কেন্দ্রীভবনজাত এই শোচনীয়তা থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে নীতির বিকেন্দ্রীকরণ। যাদের নীতিবোধ একটা নির্জীব সংস্কার মাত্র নয়, সজীব উপলব্ধির ব্যাপার, তারা তা মানতে বাধ্য। য়ুরোপে নীতির বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে বলেই জীবনের সর্বত্র, বিশেষ করে অর্থের ব্যাপারে, তার প্রয়োজনীতা অনুভূত হচ্ছে। একটি ব্যাপারেই আবদ্ধ হয়ে না থাকায় ঘৃণা সেখানে জীবনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার