পাতা:সংস্কৃতি কথা - মোতাহের হোসেন চৌধুরী.pdf/২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২২
সংস্কৃতি-কথা

সুযোগ পেয়েছে। যৌনব্যভিচারীর চেয়ে উৎকোচগ্রহণকারী সেখানে বেশী বই কম ঘৃণার পাত্র নয়। আমাদের এখানে কিন্তু ঠিক তার উল্টো। আমরা যৌনব্যভিচারীকে দেখলে নাসিকা কুঞ্চিত করি, অথচ উৎকোচগ্রহণকারীকে শ্রেষ্ঠ আসনটি দিতেও দ্বিধা করিনে।

 (বাইরের নীতির এই যে অস্বাস্থ্যকর প্রাধান্য, এর প্রতিবাদ রয়েছে হিন্দু পুরাণে। সত্যিকার মনুষ্যত্বের অধিকারী বলে তথাকথিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীরা সেখানে প্রাতঃস্মরণীয় ও প্রাতঃস্মরণীয়া বলে গৃহীত। কাল্‌চারের গোড়ার কথা যে মূল্যবোধ, তা পুরাণকারদের ছিল। তাই দেখতে পাওয়া যায় নীতিকে বড় ক’রে না দেখে তাঁরা অন্তরাত্মার মহিমাকেই বড় করে দেখেছেন, আর যেখানেই তা দেখতে পেয়েছেন সেখানেই শ্রদ্ধায় অবনতশির হয়েছেন। মনুষ্যত্ব তথা সজীব দয়া-মায়া স্নেহ-প্রীতি ও মহত্ত্বই তাঁদের পূজ্য। নীতির খোলস ভেদ করে তাঁরা মানুষের মর্মকে দেখতে সক্ষম হয়েছেন। পুরাণকারদের সেই ধারা বয়ে শরৎ বাবু সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। পুরাণকারদের মতো তিনিও সত্যিকার মনুষ্যত্ব তথা মহত্ত্বের খোঁজে—মহত্ত্বই তার কাছে মনুষ্যত্ব আর কিছু নয় যাত্রা করেন এবং সমাজপরিত্যক্ত তথাকথিত পতিত-পতিতাদের মধ্যেই তার সাক্ষাৎ পান, সভ্যভব্য নীতিপরায়ণদের জীবনে নয়। সেখানে তিনি দেখতে পেয়েছেন শুধু মিথ্যার খেলা আর সংকীর্ণতার জয়জয়কার। লেফাফাদুরস্তি ও লেবাসপোরস্তি ঠিকই আছে, নাই কেবল মনুষ্যত্বের প্রতি ঐকান্তিক টান—যার ফলে মানুষ সঙ্কট-সঙ্কুল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতেও দ্বিধা করে না।

 কিন্তু হিন্দুপুরাণের ধারাবাহী শরৎবাবু সম্বন্ধে যখন হিন্দু অধ্যাপককেই সাবধানবাক্য উচ্চারণ করতে শুনি তখন বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। হিন্দুর ঐতিহ্য যে নীতির ঐতিহ্য নয়, নীতির চেয়ে বহুগুণে শ্রেয় প্রীতির ঐতিহ্য, মহত্ত্বের ঐতিহ্য, হিন্দুঐতিহ্যের ধ্বজাবাহী অধ্যাপক মশাই তা-ই উপলব্ধি করতে পারেন না। যার কথা বলা হল, তিনি আমারও শিক্ষক আর শিক্ষক কি মুরুব্বীর সঙ্গে আমি তর্ক করতে পারিনে— ঘাবড়ে যাই, থতমত খেয়ে যাই। নইলে তাঁকে বলতুম, শরৎবাবু সম্বন্ধে তো ছেলেদের সাবধান করে দিলেন স্যার, কিন্তু শরৎবাবু যার ধারাবাহী সেই পুরাণ সম্বন্ধে তো কিছু বললেন না-বিষবৃক্ষের আগাটা কাটা হল বটে, কিন্তু গোড়াটা রয়ে গেল যে। উত্তরে তিনি কী বলতেন জানিনে, তবে যা বলতেন তা বোধ হয় এই রকম একটা কিছু আন্দাজ করা যায়: হিন্দুর প্রাতঃস্মরণীয় ও প্রাতঃস্মরণীয়াদের জীবনে যা ঘটেছে তা তাঁদের জীবনেই খাটে, অন্যের জীবনে নয়, এ কথা হিন্দু জানে, তাকে সে-কথা বুঝিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। জানে বই কি, নইলে হিন্দুর পতন হবে কী করে? যেদিন থেকে হিন্দু, দেবতাদের জন্য এক জীবন আর নিজের জন্য অন্য জীবন মেনে নিলে সেদিন থেকেই তো তার পতনের সূত্রপাত হল-নীতিধর্মী, অশক্ত, বেদনাবিহীন, দুর্বল জীবন কামনা করার ফলে। জীবনের সমৃদ্ধিকে কামনা না করে কোনোপ্রকারে টিকে থাকাকেই সে বাঞ্ছনীয় মনে করলে। আর সত্যি সত্যি কোনোপ্রকারেই সে টিকে রইল— museum specimen হয়ে। সেদিন থেকে হিন্দু-সমাজে নীতিধর্মী মাঝারির রাজত্ব স্থাপিত হল এবং অ-নীতিধর্মী মহতেরা অন্তর্ধান করলে। মহতেরা বললে: তোমার নীতি আমি মানিনে।... ...

 জীবন নিয়ে পরীক্ষা করবার অধিকার আমার আছে। আমার ভেতরে যে অমৃত লুকিয়ে আছে তা আমার চাই-ই। আর তা আমাকে আবিষ্কার করে নিতে হবে, তোমার দেওয়া ধরাবাঁধা নীতির অনুসরণ করলে পাওয়া যাবে না। কে তোমাকে শেষ কথা বলার অধিকার দিয়েছে? আমি যে অশেষের পূজারী। ছোট ছোট নীতির বাঁধনে বেঁধে