পাতা:সংস্কৃতি কথা - মোতাহের হোসেন চৌধুরী.pdf/২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সংস্কৃতি-কথা
২৩

আমার জীবনকে, আমার আগমনকে ব্যর্থ করে দিও না, আমাকেই আমার উদ্ধারকর্তা হতে দাও, আমার জীবনের নিয়ামক হতে দাও। নীতিধর্মী মাঝারি বললে: চুপ করো, অত সাহস দেখিয়ো না, ঐ পরীক্ষাতে বিলক্ষণ ভয়ের কারণ আছে, ওখানে উন্নতির সম্ভাবনার চেয়ে পতনের সম্ভাবনাই বেশী। সুতরাং সাবধান। উন্নতি না হলে থোড়াই ভাবনা, পতন না হলেই হল। আমার দেওয়া এই নীতির মাদুলি পরিধান করো, পতন থেকে রক্ষা পাবে, আর এই রক্ষা পাওয়াটাই বড় কথা। দেখো না চারিদিকে কেবলই পতনের ফাঁদ। আমার কথা শুনলে তুমি অমৃত পাবে না বটে, কিন্তু বিষ থেকে বেঁচে যাবে। আর তাই তো চাই, অমৃত না খেলেও বাঁচা যায় কিন্তু বিষ খেলে তো বাঁচা যায় না। উত্তরে মুহূর্তকামীরা বললে: তা হলে বিদায়, এক্সপেরিমেণ্টের ক্ষুধা আমার রক্তে, তোমার রাজ্যে আমার স্থান নেই। আমি অমৃতাভিসারী, মরণ ভয় আমার নেই। শুধু কোনোপ্রকারে টিকে থাকার সাধনা আমার নয়। মাঝারিরা বললে: ভালোই হল, আপদ গেছে। আমাদের সনাতন শান্তির রাজ্যে সে অশান্তির হাওয়া বইয়ে দিয়েছিল। কী কেবল অমৃত-অমৃত করে! অমৃত কি মানুষের। সে তো দেবতার। দেবতার পাতে হাত দিতে চায় যত অকালকুষ্মাণ্ডরা।

 দেবতার জন্য প্রেম, দেবতার জন্য মুহূর্ত, দেবতার জন্য সমৃদ্ধি। আমরা শুধু জন্মগ্রহণ করেছি আপিসের বড় বাবুটি হয়ে, বে-থা করে নিশ্চিন্তে ছেলের মাথায় হাতটি রেখে মরে যাওয়ার জন্য। দূরাভিসারী চিত্ত আমাদের নয়, কঠিনের সাধনাকে আমরা ভয় করি। তাই প্রেমকে ভয় করি, মহত্বকে ভয় করি, জীবন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে ভয় করি। মৃত্যুর পরে যার তহবিলে কিছু টাকা-পয়সা পাওয়া যায়, সে ব্যক্তিই আমাদের কাছে সার্থক মানুষ, তারি প্রশংসায় আমরা পঞ্চমুখ। আমাদের ছেলেদের তারি চরিত্র অধ্যয়ন ও অনুসরণ করতে বলি। ভুলে যাই যে, অন্তরের দিক দিয়ে যে যত বেশী ছোট, তারি তত বেশী টাকা-পয়সা জমাবার সম্ভাবনা। ছোটলোকামির সাধনাই আমাদের কাছে জীবন-সাধনা হয়ে দাঁড়ায়। নীতি এ সাধনার সহায়ক, একটা ধরাবাঁধা পদ্ধতির অনুসরণ না করলে আর যাই করা যাক টাকা-পয়সা করা যায় না। তাই আমরা নীতিধর্মী হয়েছি।

 কথায় কথায় হিন্দুর উন্নতি-অবনতির কথা এসে পড়ল। ভালোই হল, কথায় বলে নসীহতের চেয়ে নজীর ভালো। আর এ নজীরে বিপদের সম্ভাবনা কম। কারণ, আর যেকারণেই হোক ধর্মের সমালোচনায় হিন্দু, অন্তত বাঙ্গালী হিন্দু, উদ্দপ্ত হয় না। ধর্ম ব্যাপারে পাশাপাশি বিভিন্ন মতবাদ চলার দরুন সে অনেকখানি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা অর্জন করেছে।) ধার্মিক আর কাল্‌চার্ড মানুষে আরেকটা লক্ষ্যযোগ্য পার্থক্য এই যে, ধার্মিকের চেয়ে কাল্‌চার্ড মানুষের বন্ধন অনেক বেশী। উল্টা কথার মতো শোনালেও, কথাটি সত্য। ধার্মিকের কয়েকটি মোটা বন্ধন, সংস্কৃতিবান মানুষের বন্ধনের অন্ত নেই। অসংখ্য সূক্ষ্মচিন্তার বাঁধনে যে বাঁধা সে-ই তো ফ্রি-থিংকার আর ফ্রি থিংকিং কাল্‌চারের দান। যেখানে ফ্রি থিংকিং নেই সেখানে কাল্‌চার নেই।

 প্রশ্ন হবে: ধর্ম আর কাল্‌চারকে যেভাবে আলাদা করে দেখা হল তাতে মনে হচ্ছে নাকি ধার্মিক কখনো প্রকৃত অর্থে কাল্‌চার্ড হতে পারে না? কিন্তু কথাটি কি সত্য? ধার্মিকদের মধ্যেও তো অনেক কাল্‌চার্ড লোক দেখতে পাওয়া যায়। উত্তরে বলব: তা বটে, কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই টের পাওয়া যাবে, সেখানেও কাল্‌চারই কাল্‌চার্ড হওয়ার হেতু। অনুভূতি, কল্পনার সাধনা করেছেন বলেই তাঁরা কাল্‌চার্ড, অন্য কারণে নয়।

 একটা অভিজ্ঞতার সহায়তায় আমি কথাটা পরিষ্কার করবার চেষ্টা করছি। আমি