পাতা:সংস্কৃতি কথা - মোতাহের হোসেন চৌধুরী.pdf/২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সংস্কৃতি-কথা
২৫

তা ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই সে-সম্বন্ধে সাবধান হওয়ার দরকার। অতীতে ধর্ম ঈশ্বরকে আচ্ছন্ন করেছিল, বর্তমানে মতবাদ বা আদর্শ মনুষ্যত্বকে আচ্ছন্ন করতে পারে। লোকটা মোটের উপর ভালো কি মন্দ সেদিকে আমাদের নজর নেই, তার গায়ে কোন্ দলের মার্কা পড়েছে সেদিকেই আমাদের লক্ষ্য। মার্কাটি নিজের দলের হ'লে তার সাতখুন মাফ, না হলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার দোষ বের করা আমাদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। এই মনোবৃত্তি থেকে মুক্তি না পেলে কাল্‌চার্ড হওয়া যায় না। মনে রাখা দরকার, ধর্মের সমস্ত দোষ মতবাদের ঘাড়ে এসে চেপেছে। মতবাদী ধার্মিকের মতই অসহিষ্ণু ও সংকীর্ণ, ধার্মিকের মতোই দলবদ্ধতায় বিশ্বাসী, অধিকন্তু ধার্মিকের চেয়েও নিষ্ঠুর। ধার্মিকের নিষ্ঠুরতার সহায় ছিল ধর্মগ্রন্থের সমর্থন, মতবাদীর সহায় বিজ্ঞান। আমি আমার জন্য নিষ্ঠুর হচ্ছি না, পৃথিবী-উন্নয়নের বিজ্ঞানসম্মত আদর্শের জন্যই নিষ্ঠুর হচ্ছি। অতএব এখানে আমার গৌরব নিহিত, কলঙ্ক নয়। নিষ্ঠুরতাব্যাপারে এই যুক্তিই মতবাদীর আত্মসমর্থনের উপায়। সৌভাগ্যের বিষয় সত্যিকার সংস্কৃতিকামীরা কখনো মতবাদী হতে চায় না, মতবাদকে তারা যমের মত ভয় করে। কেননা তাদের কাজ বাইরের থেকে কোনো দর্শন গ্রহণ করা নয়, বহু বেদনায় নিজের ভিতর থেকে একটা জীবনদর্শনের জন্ম দেওয়া, এবং দিনদিন তাকে উন্নতির পথে চালনা করা।

 আইডিয়ার গোঁড়ামি থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় নিজের বা নিজের দলের অভ্রান্ততা সম্বন্ধে একটুখানি সন্দেহ রাখা। এই সন্দেহটুকুই মানুষকে সুন্দর করে তোলে, আর সৌন্দর্যই সংস্কৃতির লক্ষ্য। স্কেপ্‌টিসিজমের প্রভাব না থাকলে যে সভ্যতা সৃষ্টি হতে পারে না, এতো এক রকম অবিসংবাদিত সত্য। মনে রাখা দরকার, সংস্কৃতিবান হওয়ার কোনো ধরাবাঁধা পথ নেই, বিচিত্র পথ। কার জন্য কোন্ পথটি সার্থক কে বলবে? সেকালে বলা হ’ত যত জীব, তত শিব; এ কালে বলা যেতে পারে যত সংস্কৃতিবান মানুষ তত সংস্কৃতি-পন্থা। যে-পথটি ধরে মানুষ কাল্‌চার্ড হয় তা অলক্ষ্য না হলেও দুর্লক্ষ্য। তা পরে আবিষ্কার করা যায়, আগে নয়। তাই সংস্কৃতিবান মানুষটি একটা আলাদা মানুষ, স্বতন্ত্রসত্তা। তার জীবনের একটি আলাদা স্বাদ, আলাদা ব্যঞ্জনা থাকে। সে মতবাদীর মতো বুলি আওড়ায় না, তার প্রতিকথায় আত্মা স্পন্দিত হয়ে ওঠে। প্রেমের ব্যাপারে, সৌন্দর্যের ব্যাপারে, এমন কি সাধারণতঃ ধর্মীয় কল্যাণের ব্যাপারেও তার আত্মার ঝল্‌কানি দেখতে পাওয়া যায়। নিজের পথটি নিজেই তৈরী করে নেয় বলে সে নিজেই নিজের নবী হয়ে দাঁড়ায়। তাই সে স্বাতন্ত্র্যধর্মী, গোলে হরিবোলের জগতে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। কল্যাণের ব্যাপারে সাম্যকে স্বীকার করলেও প্রেমের ব্যাপারে, সৌন্দর্যের ব্যাপারে, চিন্তার ব্যাপারে সে স্বাতন্ত্র্য তথা বৈচিত্র্যের পক্ষপাতী। সত্যকার সংস্কৃতিকামীরা নিজেদের ছাঁচে ঢালাই করতে চায় না। নকল যীশু, নকল বুদ্ধ, নকল মার্কস বা নকল লেনিন হওয়া তাদের মনঃপুত নয়। ক্ষুদ্র হলেও তারা খাঁটি কিছু হতে চায়।

 কিন্তু পথের বিভিন্নতা থাকলেও তাদের লক্ষ্যের সাম্য রয়েছে-সকলেই অমৃত তথা আত্মাকে চায়। যীশুখৃষ্ট যখন বলেন: For what is man profited if he shall gain the whole world, and lose his own soul?— তখন সংস্কৃতিকামীর অন্তরের কথাই বলেন। এই খ্রীষ্টবাণীরই ঔপনিষদিক ভাবান্তর হচ্ছে ‘যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাম’— যা দিয়ে আমি অমৃত লাভ করব না তা দিয়ে আমি কি করব? অমৃতকে কামনা, তথা প্রেমকে কামনা, সৌন্দর্যকে কামনা, উচ্চতর জীবনকে কামনা, এই তো সংস্কৃতি। এই জন্য সংস্কৃতিকে একটা আলাদা ধর্ম, উচ্চস্তরের ধর্ম বলা হয়েছে। প্রাণিজীবনের ঊর্ধ্বে যে জীবন রয়েছে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দিয়ে, এবং তার দ্বারা প্রাণিজীবনকে