পাতা:সংস্কৃতি কথা - মোতাহের হোসেন চৌধুরী.pdf/২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৬
সংস্কৃতি-কথা

খণ্ডিত করে দিয়ে, তা মানুষের অন্তরে মুক্তির স্বাদ নিয়ে আসে। তাই বলে প্রাণিজীবনের তথা ক্ষুৎপিপাসার মূল্য যে তা দেয় না তা নয়। খুবই দেয়। Man does not live by bread alone— এই কথাটার মধ্যেই ক্ষুৎপিপাসার স্বীকৃতি রয়েছে। তবে মর্যাদাভেদ আছে। যা নিয়ে বাঁচা যায়, আর যার জন্য বাঁচতে হয়, তা কখনো এক মর্যাদা পেতে পারে না। তাই সংস্কৃতিকামীদের ইচ্ছা: ক্ষুৎপিপাসার জগৎটি তৈরী করা হোক ক্ষুৎপিপাসার ঊর্ধ্বে যে জগৎটি রয়েছে তারি পানে লক্ষ্য রেখে। নইলে সংস্কৃতি ব্যাহত হবে। সংস্কৃতিকামীরা আরো কামনা করে: ক্ষুৎপিপাসার জগৎ তথা কল্যাণের জগৎ নির্মাণে লক্ষ্যের চেয়ে উপায়কে যেন কম বড় স্থান দেওয়া না হয়। কেননা উপায়ই চরিত্রের স্রষ্টা, লক্ষ্য নয়। একবার এক রকম চরিত্র সৃষ্টি হয়ে গেলে পরে তার থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন।

 হিমালয়ের চূড়ান্ত চূড়ায় যে ধনধারা আবদ্ধ হয়ে আছে, ভগীরথের মতো সমতল ভূমিতে নামিয়ে এনে তাকে সাধারণের ভোগের বস্তু করতে না পারলে যে জগতের মুক্তি নেই, সংস্কৃতিকামীরা এ কথা স্বীকার করে; কিন্তু এই একটি সুরই তাদের জীবনে বেজে ওঠে না, সঙ্গে সঙ্গে বিচিত্রসুরের সমারোহ দেখা দেয়। একসুরা, একঝোঁকা জীবন যে দীন জীবন, তা তারা জানে। বিভিন্ন, এমন কি বিপরীত সুরের চমকে সিম্ফনি সৃষ্টি করতে না পারলে তারা খুশী হয় না। তাদের জীবনবীণাটি একতারা নয়, বহুতারসমন্বিত। তাই একত্ববাদে তাদের এতো আপত্তি। একত্ববাদী তথা মতবাদীরা অনেক সময় সূক্ষ্ম তারগুলিকে আমলই দিতে চায় না, অথচ প্রকৃত সংস্কৃতিকামীদের নজর সে-দিকেই। মতবাদীর সব চেয়ে বড় ত্রুটি এই যে, একটি আদর্শের আলোকে সমস্ত কিছু দেখতে চায় বলে সে অব্‌জেটিভ তথা তন্ময় হতে পারে না। অব্‌জেটিভ হতে হলে নিজেকে লুকোতে হয়। মতবাদী, নিজেকে, তথা নিজের মতটিকে লুকোতে পারে না বলে বিচিত্র ভাব ও অনুভূতির আগার মানুষের মর্মে গিয়ে পৌঁছতে পারে না। সে কেবল নিজের মতবাদটিকেই খোঁজে, বারে বারে ফিরে ফিরে তার সেই এক কথা। বিভিন্ন ব্যাপারকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে, এমন কি একটি ব্যাপারকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে না জানলে যে জীবন দরিদ্র থেকে যায় তা সে বোঝে না। আদর্শের গোঁড়ামির দরুন সে বৈচিত্র্যবোধ তথা জীবনবোধ হারিয়ে বসে। তাই কান পাততে নয়, মুখ খুলতেই সে ভালোবাসে। অথচ কান পাতাতেই সংস্কৃতি, মুখ খোলাতে নয়। কান পাতার ফলে যখন লোকের মনের বিচিত্র ভাব ও অনুভূতি এসে আপনার অন্তরকে অজ্ঞাতসারে ভরে তোলে, তখনই আপনি অভাবিতের দেখা পান। মুখ খুললে শুধু ‘ভাবিতে’র প্রকাশ। মতবাদী কান পাততে জানে না বলে অন্তরের দিক দিয়ে মরে যায়, যদিও হৈ-চৈ করে ব’লে ভাবে, সে-ই সব চেয়ে বেশী বেঁচে আছে। প্রবল ভাবে বাঁচা যে বাঁচা নয়, মৃত্যু। প্রচুর ভাবে, গভীর ভাবে বাঁচাই বাঁচা-সংস্কৃতিকামীই এ-সত্য উপলব্ধি করতে পারে, অপরে নয়। মতবাদ ঝড়ের মতো এসে জীবনের সমস্ত মুকুল ঝরিয়ে দেয়। সংস্কৃতি ঠিক তার উল্টো। দখিণ হাওয়ার মতো জীবনের সমস্ত ফুল ফুটিয়ে তোলাই তার কাজ। তখন কতো রং, কতো বৈচিত্র্য, কতো সৌন্দর্য। একসুরা, একরঙা জীবন মতবাদীর, সংস্কৃতিসাধনা বহুভঙ্গিম জীবনের সাধনা। Let us agree to differ—‘ভিন্নরুচির্হি লোক:’—এই উক্তিতে মতবাদীর আস্থা কম। অথচ সংস্কৃতিকামীর কাছে এর চেয়ে শ্রদ্ধেয় বাণী আর নেই।

 সাধারণ লোকের কাছে প্রগতি আর সভ্যতায় কোনো পার্থক্য নেই। যা সভ্যতা তা-ই প্রগতি, অথবা যা প্রগতি তা-ই সভ্যতা। কিন্তু কাল্‌চার্ড লোকেরা তা স্বীকার করে