পাতা:সংস্কৃতি কথা - মোতাহের হোসেন চৌধুরী.pdf/২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৮
সংস্কৃতি-কথা

 সংস্কৃতিবান মানুষ সমাজের কল্যাণ কামনা করে এবং সেজন্য প্রাণপাত করতেও প্রস্তুত থাকে। কিন্তু সবচেয়ে বেশী চায় সে নিজের জীবনে সোনা ফলাতে। কেননা সেখানে তার অবাধ অধিকার। তাই জগৎকে মেরামত করার চেয়ে নিজেকে শোধরানোর দিকেই তার অধিক ঝোঁক। তার সমুখ দিয়ে কে যেন সর্ব্বদা গান গেয়ে যায়:

মন তুমি কৃষি-কাজ জান না,
এমন মানব-জনম রইল পতিত
আবাদ করলে ফলত সোনা।

 জীবনে সোনা ফলাতে হলে যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশী প্রয়োজনীয় তা হচ্ছে সংকীর্ণ ব্যক্তিত্ব-মুক্ত হয়ে বিচিত্র জীবনধারণার সঙ্গে যোগযুক্ত হওয়া—নিজেকে বিশ্বের পানে মেলে ধরা, সংকুচিত ও সংকীর্ণ করে রাখা নয়। কবির যে প্রার্থনা— ‘যুক্ত কর হে সবার সঙ্গে, মুক্ত কর হে বন্ধ’—তাতে সংস্কৃতিকামনাই ব্যক্ত হয়েছে। সকলের সঙ্গে যুক্ত হওয়াতে মুক্তি, সকলের থেকে আলাদা হয়ে, সংকুচিত হয়ে, কূর্মের মতো আত্মগত হয়ে থাকা মুক্তি নয়, বন্ধন। ‘জীবনে জীবন যোগ করা, নহিলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা’, এই উক্তিটিও একই কামনার অভিব্যক্তি। পার্থক্য কেবল, ওখানে বাঁধনটা চাওয়া হয়েছে নিজের দিকে তাকিয়ে এবং নিজের জন্য, এখানে সকলের দিকে তাকিয়ে এবং সকলের জন্য। বাঁধন, বাঁধন, বাঁধন। সকলের সঙ্গে বাঁধন পরাতেই সমৃদ্ধি, ‘ধরণীর পরে শিথিল বাঁধন ঝলমল প্রাণ করিস যাপন’— শিথিল বাঁধন না হলে ‘ঝলমল প্রাণ’ লাভ করা যায় না। আর ঝলমল প্রাণ লাভই সংস্কৃতির উদ্দেশ্য।

 শিথিল বাঁধনের অন্তরায় বলেই সংস্কৃতিকামীরা উগ্র জাতীয়তাকে এতো ভয় করে। সব দেশে তাদের যে ঘরটি রয়েছে, সেই ঘরটি তারা খুঁজে নিতে চায়। সকল দেশের, সকল জাতির, সকল কালের লোকই তাদের আত্মীয়। তারা বিশ্বনাগরিক, অনাত্মীয়তা, মানুষকে আপন না জানা, ধর্ম বা মতবাদের বিভিন্নতার জন্য মানুষকে পর ভাবা সংস্কৃতির মনঃপুত নয়। কেননা সংস্কৃতি মানেই অহমিকামুক্তি। অহমিকার গুমটভরা অন্ধকারে সংস্কৃতিকামীর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। অহংকার পতনের মূল কিনা তা সে বলতে পারে না, কিন্তু তা যে আনন্দের অন্তরায় সে-সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ সচেতন। অহংকারী হওয়ার মানে নিজের চারদিকে বেড়া দিয়ে মানুষকে পর করা, আর মানুষকে পর করা মানে আনন্দকে পর করা। মানুষে-মানুষে মিলনেই আনন্দের জন্ম, বিরোধে নয়। বিরোধ আনন্দের শত্রু।

 সংস্কৃতিসাধনা মানে ripe হওয়ার সাধনা। সে-জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন আছে, বিজ্ঞানের প্রয়োজন আছে, কিন্তু সব চেয়ে বেশী প্রয়োজন প্রেমের। সংস্কৃতিবান হওয়ার মানে প্রেমবান হওয়া। প্রেমের তাগিদে বিচিত্র জীবনধারায় যে স্নাত হয় নি সে তো অসংস্কৃত। তার গায়ে প্রাকৃত জীবনের কটুগন্ধ লেগে রয়েছে; তা অসহ্য। ‘সবার পরশে-পবিত্র-করা তীর্থ-নীরে’, স্নাত না হ’লে সংস্কৃতিবান হওয়া যায় না।