পাতা:সংস্কৃতি কথা - মোতাহের হোসেন চৌধুরী.pdf/৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৬৭

মেরুদণ্ড

If the wicked flourish and the fittest survive, Nature must be the God of rascals. —G.B.S.

 যেদিন ‘সারভাইভাল অব দি ফিটেস্ট’—এই সাধারণ সত্যটি দার্শনিকের কণ্ঠে প্রথম ঘোষিত হল, সেদিন থেকেই পৃথিবীর সর্বনাশের সূত্রপাত। কেননা, মূল্যবোধ বিস্মৃত হয়ে মানুষ তার শ্রেষ্ঠ গুণরাজিকে অবহেলা করে নিকৃষ্ট শক্তিসমূহের পূজার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলে, আর শুধু বাঁচার কথাটা বড় হয়ে উঠল বলে সৌন্দর্য, প্রেম ও আনন্দ মানুষের দৃষ্টিসীমা থেকে অনেক দূরে সরে গেল। সে বুঝতে পারলে, এ-সব গৌণ ব্যাপার, বাঁচার জন্য এ-সবের কোনো প্রয়োজন নেই, যদি পাওয়া যায় ভালো। অধিকন্তু না দোষায়-না পাওয়া গেলেও তেমন দুঃখ নেই।

 দার্শনিকের চেষ্টা হয় অনেক সময় ‘ম্যাচ এডো এবাউট নাথিং’, অথবা পর্বতের মূষিক প্রসবের মতো। অনেক মাল-মসলা সংগ্রহ ও গবেষণার ফলে তাঁরা যে সত্যে এসে পৌঁছোন, অনেক সময় তা’ মামুলি সত্য ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু দর্শনের সমর্থনে তাই হয়ে ওঠে সকলের শ্রদ্ধেয় সাধারণ ব্যাপারটাও অসাধারণ হয়ে দেখা দেয়। ‘ফিট’ লোকেরাই সব সময় বেঁচেছে ও বাঁচবে এ কথাটা বলার জন্য দার্শনিকের গবেষণার প্রয়োজন হয় না, সামান্য পর্যবেক্ষণশীলেরাও তা বলতে পারে। সুতরাং এ সিদ্ধান্তের জন্য দার্শনিকের কোনো কৃতিত্ব নেই; তাঁর কৃতিত্ব সত্যে পৌঁছার জন্য তাঁর যে আয়োজন তাতে, উপাদান-সংগ্রহ ও বিচিত্র তথ্য আবিষ্কারে মানুষ হঠাৎ-সৃষ্ট জীব নয়, জীবপরম্পরায় ধারাবাহিক পরিণতি, এই সত্যের উদ্‌ঘাটনে।

 অথচ মানুষ সেইটেই বড় বলে গ্রহণ করল— নাচুনে বুড়ি ঢোলের তালি পেলে যেমন আনন্দে আত্মহারা হয়, মানুষও তেমনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজের ভিতরের যুদ্ধংদেহি ভাবটিকে আঁকড়ে ধরল-তেল-সিঁদুর দিয়ে দেবতার মতো তার পূজা শুরু করলে। নিজেরা যা স্বভাবতঃই ভালোবাসে দার্শনিকের সমর্থনে, তাই তাদের কাছে অধিকতর প্রিয় হয়ে উঠল; আর দার্শনিকরা যা ধরতে ছুঁতে পান না; মানবজীবনের সেই শ্রেষ্ঠ সম্পদ ধ্যান-কল্পনা প্রেম-সৌন্দর্যের কদর কমতে লাগল। এ সব কী? বিজ্ঞান তো এ সব ঠাহর করতে পারে না। সুতরাং এদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান না হয়ে উপায় কী/ সত্য তাই; বিজ্ঞানের সহায়তায় যাচাই করতে গেলে মূল্যের তো কথাই নেই, এ সবের কোনো অস্তিত্বই থাকে না। কেননা, মানুষ যেখানে প্রকৃতির সৃষ্টি সেখানেই বিজ্ঞানের অধিকার, যেখানে সে নিজের রচনা সেখানে বিজ্ঞান বেকার। প্রেম, সৌন্দর্য ইত্যাদি মানুষের নিজের সৃষ্টি বলে বিজ্ঞান এদের সম্বন্ধে নির্বাক অথবা সন্দিহান। কিন্তু এদের সাধনাই মনুষ্যত্বের সাধনা, তথা সভ্যতার সাধনা। ‘যোগ্যতমের ঊর্ধ্বতন’ নীতি এই সাধনার পরিপন্থী, কেননা তা’ শুধু বাঁচবার জন্য প্রয়োজনীয় নখদন্ত ও নখদন্তের স্থানীয় বন্দুক-বোমা-সঙ্গীনকেই বড় করে তোলে-উদার বুদ্ধিকে বর্জন করে সঙ্কীর্ণ বুদ্ধির আশ্রয় গ্রহণ করতে শেখায়। ফলে মানুষের অধোগতি ঘটে।