পাতা:সঞ্চয়িতা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চিত্রা
২৭১

পাণ্ডু আকাশে খণ্ড চন্দ্র হিমানীর-গ্লানি-মাথা;
পল্লবহীন বৃদ্ধ অশথ শিহরে নগ্নশাখা।
নীরবে রমণী অঙ্গুলি তুলি দিল ইঙ্গিত করি—
মন্ত্রমুগ্ধ অচেতন-সম চড়িনু অশ্ব-’পরি।

বিদ্যুৎবেগে ছুটে যায় ঘোড়া বারেক চাহিনু পিছে,
ঘরদ্বার মোর বাষ্পসমান মনে হল সব মিছে।
কাতর রোদন জাগিয়া উঠিল সকল হৃদয় ব্যেপে,
কণ্ঠের কাছে সুকঠিন বলে কে তারে ধরিল চেপে!
পথের দু ধারে রুদ্ধদুয়ারে দাঁড়ায়ে সৌধসারি,
ঘরে ঘরে হায় সুখশয্যায় ঘুমাইছে নরনারী।
নির্জন পথ চিত্রিতবৎ, সাড়া নাই সারা দেশে—
রাজার দুয়ারে দুইটি প্রহরী ঢুলিছে নিদ্রাবেশে।
শুধু থেকে থেকে ডাকিছে কুকুর সুদূর পথের মাঝে—
গম্ভীর স্বরে প্রাসাদশিখরে প্রহরঘণ্টা বাজে।

অফুরান পথ, অফুরান রাতি, অজানা নূতন ঠাঁই—
অপরূপ এক স্বপ্নসমান, অর্থ কিছুই নাই।
কী যে দেখেছিনু মনে নাহি পড়ে, ছিল নাকো আগাগোড়া—
লক্ষ্যবিহীন তীরের মতন ছুটিয়া চলেছে ঘোড়া।
চরণে তাদের শব্দ বাজে না, উড়ে নাকো ধূলিরেখা,
কঠিন ভূতল নাই যেন কোথা, সকলি বাষ্পে লেখা।
মাঝে মাঝে যেন চেনা-চেনা-মতো মনে হয় থেকে থেকে—
নিমেষ ফেলিতে দেখিতে না পাই কোথা পথ যায় বেঁকে।
মনে হল মেঘ, মনে হল পাখি, মনে হল কিশলয়—
ভালো করে যেই দেখিবারে যাই মনে হল কিছু নয়।
দুই ধারে একি প্রাসাদের সারি, অথবা তরুর মূল,
অথবা এ শুধু আকাশ জুড়িয়া আমারি মনের ভুল!